পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/১৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৪
কালান্তর

চড়তে লাগল। রাত এগারোটা হয়, দুপুর বাজে, ওরা থামতেই চায় না। কেননা, থামবার কোনোই সংগত কারণ নেই। সঙ্গে যদি গান থাকত তা হলে সময় থাকত। কিন্তু অরাজক তালের গতি আছে, শান্তি নেই—উত্তেজনা আছে, পরিতৃপ্তি নেই। সেই তাল-মাতালের দল প্রতি ক্ষণেই ভাবছিল, ভরপুর মজা হচ্ছে। আমি ছিলেম তাণ্ডবের বাইরে; আমিই বুঝছিলেম, গানহীন তালের দৌরাত্ম্য বড়ো অসহ্য।

 তেমনি করেই আট্‌লাণ্টিকের ও পারে ইট-পাথরের জঙ্গলে বসে আমার মন প্রতিদিনই পীড়িত হয়ে বলেছে, তালের খচমচ’র অন্ত নেই, কিন্তু সুর কোথায়? আরো চাই, আরো চাই, আরো চাই—এ বাণীতে তো সৃষ্টির সুর লাগে না। তাই সেদিন সেই ভ্রুকুটিকুটিল অভ্রভেদী ঐশ্বর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ধনমানহীন ভারতের একটি সন্তান প্রতিদিন ধিক্কারের সঙ্গে বলেছে: ততঃ কিম!

 এ কথা বারবার বলেছি, আবার বলি, আমি বৈরাগ্যের নাম করে শূন্য ঝুলির সমর্থন করি নে। আমি এই বলি, অন্তরে গান বলে সত্যটি যদি ভরপুর থাকে তবে তার সাধনায় সুর তালের চেষ্টা থাকে রসের সংযম-রক্ষার—বাহিরের বৈরাগ্য অন্তরের পূর্ণতার সাক্ষ্য দেয়। কোলাহলের উজ্জ্বল নেশায় সংযমের কোনো বালাই নেই। অন্তরে প্রেম বলে সত্যটি যদি থাকে তবে তার সাধনায় ভোগকে হতে হয় সংযত, সেবাকে হতে হয় খাটি। এই সাধনার সতীত্ব থাকা চাই। এই সতীত্বের যে বৈরাগ্য অর্থাৎ সংযম সেই হল প্রকৃত বৈরাগ্য। অন্নপূর্ণার সঙ্গে বৈরাগির যে মিলন সেই হল প্রকৃত মিলন।

 যখন জাপানে ছিলেন তখন প্রাচীন জাপানের যে রূপ সেখানে দেখেছি সে আমাকে গভীর তৃপ্তি দিয়েছে। কেননা, অর্থহীন বহুলতা তার বাহন নয়। প্রাচীন জাপান আপন হৃৎপদ্মের মাঝখানে সুন্দরকে পেয়েছিল। তার সমস্ত বেশভূষা, কর্ম, খেলা, তার বাসা, আসবাব, তার