পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৬
কালান্তর

আমার সব দুঃখ ঘুচবে।’ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ভুলের পরে নিজের ভুল যোগ করে দিয়ে সংশোধন চলে না। জুতো পেলেও তার জুতো খসে পড়বে, ছাতি পেলেও তার ছাতি হাওয়ায় দেবে উড়িয়ে, আর মনের মতো লাঠি যদি সে কোনোমতে জোগাড় করতে পারে অন্য পাড়ার দেহটি সে লাঠি ছিনিয়ে নিয়ে তার নড়বড়ে জীবলীলার প্রহসনটাকে হয়তো ট্র্যাজেডিতে সমাপ্ত করে দিতে পারে। এখানে জুতো জামা ছাতি লাঠির অভাবটাই সমস্যা নয়, প্রাণগত ঐক্যের অভাবটাই সমস্যা। কিন্তু বিধাতার উক্ত দেহরূপী বিদ্রুপটি হয়তো বলে থাকে যে, ‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনৈক্যের কথাটা এখন চাপা থাক্‌, আপাতত সবার আগে যদি কোনো গতিকে একটা জামা জোগাড় করে নিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকতে পারি তা হলে সেই জামাটার ঐক্যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঐক্য আপনা-আপনি ঘটে উঠবে।’ আপনিই ঘটবে, এ কথা বলা হচ্ছে নিজেকে ফাঁকি দেওয়া। এই ফাকি সর্বনেশে; কেননা, নিজকৃত ফঁকিকে মানুষ ভালোবাসে, তাকে যাচাই করে দেখতেই প্রবৃত্তি হয় না।

 মনে আছে, আমার বয়স যখন অল্প ছিল তখন দেশে দুই বিরোধী পক্ষের মধ্যে একটা তর্ক প্রায় শোনা যেত, আমরা কি নেশন না নেশন নই। কথাটা সম্পূর্ণ বুঝতুম তা বলতে পারি নে, কিন্তু আমরা নেশন নই এ কথা যে মানুষ বলত রাজা হলে তাকে জেলে দিতুম, সমাজপতি হলে তার ধোবা নাপিত বন্ধ করতুম। তার প্রতি অহিংস্রভাব রক্ষা করা আমার পক্ষে কঠিন হত। তখন এ সম্বন্ধে একটা বাঁধা তর্ক এই ছিল যে সুইজর্‌ল্যাণ্ডে তিন ভিন্ন জাত পাশাপাশি রয়েছে তবুও তো তারা এক নেশন, তবে আর কী! শুনে ভাবতুম, যাক, ভয় নেই। কিন্তু মুখে ভয় নেই বললেও আসলে ভয় ঘোচে কই? ফাঁসির আসামিকে তার মোক্তার যখন বলেছিল ‘ভয় কী, দুর্গা বলে ঝুলে পড়ো’, তখন সে সান্ত্বনা পায় নি; কেননা দুর্গা বলতে সে রাজি, কিন্তু ঐ ঝুলে পড়াটাতেই আপত্তি।