পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০
কালান্তর

জাপানে পণ্য ও চিত্ত-বিনিময় চলিত, এই রুদ্র মরু সে পথের চিহ্ন মুছিয়া দিল; কত যুগের প্রাণচঞ্চল ইতিহাসকে বালু চাপা দিয়া সে কঙ্কালসার করিয়া দিয়াছে। উলঙ্গ ধূর্জটি সেখানে একা স্থাণু হইয়া ঊর্ধ্বনেত্রে বসিয়া আছেন; উমা নাই। দেবতারা তাই প্রমাদ গণিতেছেন— কুমারের জন্ম হইবে কেমন করিয়া? নূতন প্রাণের বিকাশ হইবে কী উপায়ে?

 জোর করিয়া চোখ বুজিয়া যদি না থাকি, তবে নিজের সমাজের দিকে তাকাইলেও এই চেহারাই দেখিতে পাইব। এখানে স্থলের স্থাবরতা ভয়ংকর হইয়া বসিয়া আছে- এ যে পকেশের শুভ্র মরুভূমি। এখানে এককালে যখন প্রাণের রস বহিত তখন ইতিহাস সজীব হইয়া, সচল ইয়া, কেবল যে এক প্রদেশ হইতে আর-এক প্রদেশে ব্যাপ্ত হইত, তাহা হে- মহতী স্রোতস্বিনীর মতাে দেশ হইতে দেশান্তরে চলিয়া যাইত। বিশ্বের সঙ্গে সেই প্রাণবিনিময়ের, সেই পণ্যবিনিময়ের ধারা ও তাহার বিপুল রাজপথ কবে কোন কালে বালু চাপা পড়িয়া গেছে। এখানে সেখানে মাটি খুঁড়িয়া বাহনদের কঙ্কাল খুঁজিয়া পাওয়া যায়, পুরাতত্ত্ববিদের খনিত্রের মুখে পণ্যসামগ্রীর দুটো-একটা ভাঙা টুকরা উঠিয়া পড়ে। গুহাগহূরে গহনে সেকালের শিল্পপ্রবাহিণীর কিছু কিছু অংশ আটকা পড়িয়া গেছে; কিন্তু আজ তাহা স্থির, তাহার ধারা নাই। সমস্ত স্বপ্নের মতাে মনে হয়। আমাদের সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ কী? সমস্ত সৃষ্টির স্রোত বন্ধ। যাহা আছে তাহা আছে, যাহা ছিল তাহা কেবলই তলাইয়া যাইতেছে।

 চার দিক এমনি নিস্তব্ধ নিশ্চল যে মনে ভ্রম হয়, ইহাই সনাতন। কখনােই নহে, ইহাই নূতন। এই মরুভূমি সনাতন নহে, ইহার বহু পূর্বে এখানে প্রাণের নব নব লীলা চলিত সেই লীলায় কত বিজ্ঞান দর্শন, শিল্প সাহিত্য, রাজ্য সাম্রাজ্য, কত ধর্ম ও সমাজ-বিপ্লব তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছে। কিছু না করিয়া একবার মহাভারতটা পড়িয়া দেখিলেই দেখা যাইবে, সমাজটা কোনাে সংহিতা কারখানাঘরের ঢালাই-পেটাই-করা ও