পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৪০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রলয়ের সৃষ্টি

এক সময়ে, এই বিশ্বসৃষ্টির প্রথম যুগে সৃষ্টি ও প্রলয়ের দ্বন্দ্বনৃত্য চলেছিল- সৃষ্টি ও প্রলয়ের শক্তির মধ্যে কে যে বড়ো তা বুঝবার জো ছিল না, চারি দিকে নিয়ত সংঘাত চলেছিল। তখন যদি বাইরে থেকে কেউ এই পৃথিবীকে দেখতে পেত তা হলে বলত, এই বিশ্ব প্রলয়েরই লীলাক্ষেত্র, সৃষ্টির নয়। চারি দিকে তখন ক্রমাগত ভয়ংকরের নাট্যলীলা চলেছিল। সেই মহাতাণ্ডবের যুগে আমরা যাকে প্রাকৃত জগৎ বলি তাই ছিল, তখন পৃথিবীতে জীব আসে নি। কিন্তু এই মহাপ্রলয়ের অন্তরে সৃষ্টির সত্যই গোপন হয়ে ছিল। যা বিনাশ করে, যা ভীষণ, বাইরে থেকে তাকেই সত্য বলে মনে হলেও তা সত্য নয়— এই ভীষণ তাণ্ডবলীলাই সৃষ্টির ক্ষেত্রে চরম কথা নয়। ক্রমশ সব আলোড়ন উপদ্রব থেমে গেল, এর অন্তরে যে সৌন্দর্যলীলা গোপন ছিল তাই প্রকাশ পেল সেই প্রলয়ের তাণ্ডব, সেই ঝড়ঝঞ্জা-মহামারী আজও আছে বটে, কিন্তু সে আছে নেপথ্যে— সে একবার দেখা দেয়, আবার চলে যায়— তাকেই আমরা চরম পরিণাম বলি নে। সমস্ত উপদ্রব শান্ত হয়ে আসে, উপনিষদে যাঁকে শান্ত বলেছে তাঁরই রূপ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। আকাশে নক্ষত্রে নক্ষত্রে যে হোমহুতাশন, অগ্নির উচ্ছ্বাস, আমরা দেখি তার শান্তরূপ। নক্ষত্রলোক জুড়ে কী অসহ্য উপদ্রব, কী অগ্নিবাষ্পের উচ্ছ্বাস চলেছে সে কথা আমরা ভাবি নে। আমাদের শয়নগৃহের বাতায়ন দিয়ে যখন আকাশকে দেখি তখন দেখি তার স্নিগ্ধ রূপ, তখন দেখি আকাশ হাসছে— সে আমাদের নিদ্রাকে ব্যাহত করে না। এই শান্তিই চরম সত্য— এ শান্তি দুর্বলের শাস্তি নয়, এ প্রবলের শান্তি।