পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০৬
কালান্তর

উল্লাস চরমরূপে এতে বর্ণিত হয় নি। এতে দেখা যায়, জিত সম্পদকে কুরুক্ষেত্রের চিতাভস্মের কাছে পরিত্যাগ করে বিজয়ী পাণ্ডব বিপুল বৈরাগ্যের পথে শান্তিলোকের অভিমুখে প্রয়াণ করলেন— এ কাব্যের এই চরম নির্দেশ। এই নির্দেশ সকল কালে সকল মানবের প্রতি। যে ভোগ একান্ত স্বার্থগত, ত্যাগের দ্বারা তাকে ক্ষালন করতে হবে। যে ভোগে সর্বমানবের ভোজের আহ্বান আছে সভ্যতার স্বরূপ আছে তার মধ্যে। কিন্তু রিপু অতি প্রবল, সাধনা অতি দুরূহ; সেই কারণেই এই সাধনায় যত দূর সিদ্ধি লাভ করা যায় মনুষ্যত্বের গৌরব তত দূর প্রসারিত হতে থাকে, ব্যাপ্ত হতে থাকে তার সভ্যতা।

 যুগ প্রতিকূল, বর্বরতা বলিষ্ঠতার মর্যাদা গ্রহণ করে আপন পতাকা আন্দোলন করে বেড়াচ্ছে রক্তপঙ্কিল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিকারগ্রস্ত রোগীর সাংঘাতিক আক্ষেপকে যেন আমরা শক্তির পরিচয় বলে ভুল না করি। লোভ যে সম্পদ আহরণ করে আনে তাকে মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত ঐশ্বর্য বলে জ্ঞান করে এসেছে, এবং অহংকৃত হয়েছে সঞ্চয়ের মরীচিকায়। লোভের ভাণ্ডারকে রক্ষা করবার জন্যে জগৎ জুড়ে অস্ত্রসজ্জা, যুদ্ধের আয়োজন চলল। সেই ঐশ্বর্য আজ ভেঙেচুরে তার ভগ্নাবশেষের তলায় মনুষ্যত্বকে নিষ্পিষ্ট করে দিচ্ছে।

 আমার অধিক কিছু বলবার নেই, শক্তিও নেই। মানবসত্যের শেষ বাণী আমাদের দেশে উচ্চারিত হয়েছে, আমি আজ কেবল তারই প্রত্যুচ্চারণ করে বিদায় গ্রহণ করি।—

সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে
সংবাদে ছিল না মুখরিত
নিস্তব্ধ খ্যাতির যুগে—
আজিকার এইমতো প্রাণযাত্রাকল্লোলিত প্রাতে
যাঁরা যাত্রা করেছেন