পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম
৫৫

মাখি এবং ভাঙা পিপের আলকাতার মতো সেটাকে দেশের চার দিকে। গড়াইয়া ছড়াইয়া পড়িতে দিই।

 কথাটা শুনিতে ছোটো, কিন্তু আসলে ছোটো নয়। কোথাও আমাদের। কোনো কর্তৃত্ব আছে, এটা আমরা কিছুতেই পুরামাত্রায় বুঝিলাম না। বইয়ে পড়িয়াছি, মাছ ছিল কাঁচের টবের মধ্যে, সে অনেক মাথা খুঁড়িয়া অবশেষে বুঝিল যে, কাঁচটা জল নয়। তার পরে সে বড়ো জলাশয়ে ছাড়া পাইল, তবু তার এটা বুঝিতে সাহস হইল না যে, জলটা কাঁচ নয়; তাই সে একটুখানি জায়গাতেই ঘুরিতে লাগিল। ঐ মাথা ঠুকিবার ভয়টা আমাদেরও হাড়ে মাসে জড়ানো, তাই যেখানে সাঁতার চলিতে পারে সেখানেও মন চলে না। অভিমন্যু মায়ের গর্ভেই ব্যূহে প্রবেশ করিবার বিদ্যা শিখিল, বাহির হইবার বিদ্যা শিখিল না, তাই সে সর্বাঙ্গে সপ্তরথীর মারটা খাইয়াছে। আমরাও জন্মিবার পূর্ব হইতেই বাঁধা পড়িবার বিদ্যাটাই শিখিলাম, গাঁঠ খুলিবার বিদ্যাটা নয়; তার পর জন্ম-মাত্রই বুদ্ধিটা হইতে শুরু করিয়া চলাফেরাটা পর্যন্ত পাকে পাকে জড়াইলাম, আর সেই হইতে জগতে যেখানে যত রথী আছে, এমন-কি পদাতিক পর্যন্ত, সকলের মার খাইয়া মরিতেছি। মানুষকে, পুঁথিকে, ইশারাকে, গণ্ডিকে বিনা বাক্যে পুরুষে পুরুষে মানিয়া চলাই এমনি আমাদের অভ্যস্ত যে, জগতে কোথাও যে আমাদের কর্তৃত্ব আছে তাহা চোখের সামনে সশরীরে উপস্থিত হইলেও কোনোমতেই ঠাহর হয় না, এমন-কি, বিলাতি চশমা পরিলেও না।

 মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো কথাটাই এই যে কর্তৃত্বের অধিকারই মনুষ্যত্বের অধিকার। নানা মন্ত্রে, নানা শ্লোকে, নানা বিধিবিধানে এই কথাটা যে দেশে চাপা পড়িল, বিচারে পাছে এতটুকু ভুল হয় এইজন্য যে দেশে মানুষ আচারে আপনাকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধে, চলিতে গেলে পাছে দূরে গিয়া পড়ে, এইজন্য নিজের পথ নিজেই ভাঙিয়া দেয়, সেই দেশে ধর্মের দোহাই দিয়া মানুষকে নিজের ’পরে অপরিসীম অশ্রদ্ধা করিতে