পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম
৫৯

য়ুরোপীয় সভ্যতার পাকা ভিত। ব্যক্তিবিশেষের সফলতা কোনো বিশেষ বিধানে নয়, বিশ্ববিধানে— এইটে শক্ত করিয়া জানাতেই শক্তির ক্ষেত্রে য়ুরোপের এত বড়ো মুক্তি।

 আমরা কিন্তু দুই হাত উল্টাইয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিতেছি— কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সেই কর্তাটিকে— ঘরের বাপদাদা, বা পুলিসের দারোগা, বা পাণ্ডা পুরোহিত, বা স্মৃতিরত্ন, বা শীতলা মনসা ওলাবিবি দক্ষিণরায়, শনি মঙ্গল রাহু কেতু প্রভৃতি হাজার রকম নাম দিয়া নিজের শক্তিকে হাজার টুকরা করিয়া আকাশে উড়াইয়া দিল।

 কালেজি পাঠক বলিবেন, ‘আমরা তো এ-সব মানি না। আমরা তো বসন্তের টিকা লই; ওলাউঠা হইলে নুনের জলের পিচকিরি লইবার আয়োজন করি; এমন-কি, মশাবাহিনী ম্যালেরিয়াকে আজও আমরা দেবী বলিয়া খাড়া করি নাই, তাকে আমরা কীটস্য কীট বলিয়াই গণ্য করি’— এবং ‘সেই সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রভরা তাবিজটাকে পেটভরা পিলের উপর ঝুলাইয়া রাখি’।

 মুখে কোণ্টাকে মানি বা নাই মানি তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু ঐ মানার বিষে আমাদের মনের ভিতরটা জর্জরিত। এই মানসিক কাপুরুষতার ভিত্তি একটা চরাচরব্যাপী অনিশ্চিত ভয়ের উপর। অখণ্ড বিশ্বনিয়মের মধ্যে প্রকাশিত অখণ্ড বিশ্বশক্তিকে মানি না বলিয়াই হাজার রকম ভয়ের কল্পনায় বুদ্ধিটাকে আগেভাগে বরখাস্ত করিয়া বসি। ভয় কেবলই বলে, কী জানি, কাজ কী। ভয় জিনিসটাই এইরকম। আমাদের রাজপুরুষদের মধ্যেও দেখি, রাজ্যশাসনের কোনো একটা ছিদ্র দিয়া ভয় ঢুকিলেই তারা পাশ্চাত্য স্বর্ধমকেই ভুলিয়া যায়, যে ধ্রুব আইন তাদের শক্তির ধ্রুব নির্ভর তারই উপর চোখ বুজিয়া কুড়াল চালাইতে থাকে। তখন ন্যায়রক্ষার উপর ভরসা চলিয়া যায়, প্রেস্টিজরক্ষাকে তার চেয়ে বড়ো মনে করে। এবং বিধাতার উপর টেক্কা দিয়া ভাবে, প্রজার চোখের