পাতা:কৃষ্ণকান্তের উইল-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ দেখ, ধীরে ধীরে শীর্ণশরীর চিত্রানদী বহিতেছে—তীরে অশ্বথ কদম্ব আম্র খজুর প্রভৃতি অসংখ্য বৃক্ষশোভিত উপবনে কোকিল দয়েল পাপিয়! ডাকিতেছে। নিকটে গ্রাম নাই ; প্রসাদপুর নামে একটি ক্ষুদ্র বাজার প্রায় এক ক্রোশ পথ দূর। এখানে মনুষ্যসমাগম নাই দেখিয়া, নি:শঙ্কে পাপাচরণ করিবার স্থান বুঝিয়া, পূর্বকালে এক নীলকর সাহেব, এইখানে এক নীলকুঠি প্রস্তুত করিয়াছিল। এক্ষণে নীলকর এবং তাহার ঐশ্বৰ্য্য ধ্বংসপুরে প্রয়াণ করিয়াছে—তাহার আমীন তাগাদগীর নায়েব গোমস্ত সকলে উপযুক্ত স্থানে স্বকৰ্ম্মার্জিত ফলভোগ করিতেছেন। এক জন বাঙ্গালী সেই জনশূন্য প্রান্তরস্থিত রম্য অট্টালিকা ক্রয় করিয়া, তাহা সুসজ্জিত করিয়াছিলেন । পুষ্পে, প্রস্তরপুত্তলে, আসনে, দর্পণে, চিত্রে, গৃহ বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার অভ্যন্তরে দ্বিতলস্থ বৃহৎ কক্ষমধ্যে আমরা প্রবেশ করি। কক্ষমধ্যে কতকগুলি রমণীয় চিত্র-কিন্তু কতকগুলি মুরুচিবিগহিত-অবর্ণনীয় । নিৰ্ম্মল সুকোমল আসনোপরি উপবেশন করিয়া এক জন শ্মশ্রীধারী মুসলমান একটা তল্লুরার কাণ মুচড়াইতেছে-কাছে বসিয়া এক যুবতী ঠিং ঠিং করিয়া একটি তবলায় ঘা দিতেছে— সঙ্গে সঙ্গে হাতের স্বর্ণালঙ্কার ঝিন্‌ ঝিন্‌ করিয়া বাজিতেছে—পার্শ্বস্থ প্রাচীরবিলম্বী দুইখানি বৃহৎ দর্পণে উভয়ের ছায়াও ঐরূপ করিতেছিল। পাশের ঘরে বসিয়া, একজন যুব পুরুষ নবেল পড়িতেছেন এবং মধ্যস্থ মুক্ত দ্বারপথে যুবতীর কার্য্য দেখিতেছেন। তম্বুরার কাণ মুচড়াইতে মুচড়াইতে দাড়ীধারী তাহার তারে অঙ্গুলি দিতেছিল। যখন তারের মেও মেও আর তবলার খ্যান খ্যান ওস্তাদজীর বিবেচনায় এক হইয়া মিলিল —তখন তিনি সেই গুম্ফ শ্মশ্রীর অন্ধকারমধ্য হইতে কতকগুলি তুষারধবল দন্ত বিনির্গত করিয়া, বৃষভতূলভ কণ্ঠরব বাহির করিতে আরম্ভ করিলেন। রব নির্গত করিতে করিতে সে তুষারধবল দস্তুগুলি বহুবিধ খিচুনিতে পরিণত হইতে লাগিল ; এবং ভ্রমরকৃষ্ণ শ্মশ্র রাশি তাহার অনুবর্তন করিয়া নানাপ্রকার রঙ্গ করিতে লাগিল। তখন যুবতী খিচুনিসন্তাড়িত হইয়া সেই বৃষভকুলভ রবের সঙ্গে আপনার কোমল কণ্ঠ মিশাইয়া গীত আরম্ভ করিল— তাহাতে সরু মোট আওয়াজে, সোনালি রূপালি রকম একপ্রকার গীত হইতে লাগিল । এইখানে যবনিক। পতন করিতে ইচ্ছা হয়। যাহা অপবিত্র, আদর্শনীয়, তাহ আমরা দেখাইব না-যাহ নিতান্ত না বলিলে নয়, তাহাই বলিব। কিন্তু তথাপি সেই অশোক বকুল কুটজ কুরুবক কুঞ্জমধ্যে ভ্রমরগুঞ্জন, কোকিলকুজন, সেই ক্ষুদ্ৰনদীতরঙ্গচালিত