উপলব্ধি করিতে পারেন। ভাই গিরীশচন্দ্র তাহার অনুবাদের প্রথম সংস্করণের (১২৯২ সাল ) ভূমিকায় বলিয়াছেন—“অল্প কথায় বিস্তৃত ভাব ব্যক্ত করিতে আরব্য ভাষা যেরূপ অনুকূল, এমন পূর্ণ ভাষা যে সংস্কৃত, তদ্বিষয়ে অনেক স্থলে পরাস্ত । আরবীয় একটী কথার ভাব ব্যক্ত করিতে বাংলা ভাষায় প্রায় তাহার দ্বিগুণ ত্রিগুণ কথা প্রয়োগ করিতে হয়।” সাধারণ আরবী ভাষার এই অবস্থা, কোর-আনের সাহিত্য আবার ইহার মধ্যে নানা গুণ-বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
কোর-আনের অনুবাদ সম্বন্ধে ইহাই একমাত্র কথা নহে । কোর্-আনের হউক, অথবা অন্য কোন ধৰ্ম্ম গ্রন্থের হউক, তাহার অনুবাদক ও টীকাকারের জন্য কেবল সাহিত্যগত জ্ঞানই যথেষ্ট জ্ঞান বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না । তাহার পক্ষে আরও দরকার হয় সেই গ্রন্থের ভাবগত পরিবেষের সহিত সত্যকার পরিচয়ের । শুধু ইহাই নহে। ধৰ্ম্ম গ্রন্থকে কেবল বিদ্যাগত বা জ্ঞানগত করিয়াই ক্ষান্ত হইবেন র্যাহার, তাহাদিগকেও আমরা এই মহান সাধনার অনধিকারী বলিয়াই মনে করিব। এক্ষেত্রে সব চাইতে বেশী দরকার হয়, সেই গ্রন্থকে নিজের আত্মগত করিয়া লওয়া। কারণ ধৰ্ম্মগ্রন্থের আসল কাজ কারবার হইতেছে মানুষের আত্মিক জগতের সহিত এবং ন্যায় দর্শনাদি সাধারণ জ্ঞান-শাস্ত্রের সহিত স্বৰ্গীয় ধৰ্ম্মগ্রন্থসমূহের প্রধান পার্থক্যও বোধ হয় এইখানে । ফলতঃ এই ব্রত যাপনের জন্য চাই-সেই শাস্ত্রের মূল ভাবধারার প্রতি লেখকের অস্তরের গভীর নিষ্ঠ। কোর-আনের প্রথম বঙ্গানুবাদক ও হজরত মোহাম্মাদ মোস্তাফার প্রথম বাঙ্গালী চরিতকার ভক্তিভাজন ভাই গিরীশচন্দ্রের এ সমস্ত গুণই ছিল, তাই তাহার সাধনা সার্থক হইয়াছে।
ভাই গিরীশচন্দ্র ভক্ত, সাধক ও অসাধারণ তেজোদৃপ্ত কৰ্ম্মযোগী। তাহার গুণ গরিমার পরিচয় দিতে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নাই, তাহার কৰ্ম্মজীবনের সমালোচনা করার অবকাশও এক্ষেত্রে নাই। শুনিয়াছি, কোর-আনের ও অন্যান্য এছলামী ধৰ্ম্মগ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশের গুরু দায়িত্ব গিরিশচন্দ্রের উপর ন্যস্ত করার সময় কেশবচন্দ্র প্রার্থনা করিয়াছিলেন—“তোমার জীবন মহাপুরুষ মোহাম্মাদের স্পিরিটে মহিমান্বিত ও অনুপ্রাণিত হউক ?” তাহার ধৰ্ম্মজীবনের সব সাধন ও সিদ্ধির মধ্যে এই প্রার্থনাটী সার্থক হইয়া আছে, এই সংক্ষিপ্ত মস্তব্যে আজ এইটুকু বলিলেই বোধ হয় যথেষ্ট হইবে। বাংলার তিন কোটি মুছলমান জনসাধারণকে তাহদের আল্লার, রছুলের ও কোর-আনের সহিত পরিচিত করিয়াছেন সর্বপ্রথমে তিনিই। তাহারই অক্লাস্ত সাধনার সম্যকৃ ফলেই বাংলার পাঁচ কোটি অধিবাসী কোর-আন শরীফের, এছলাম ধর্শ্বের ও হজরত মোহাম্মাদ মোস্তাফার স্বরূপ সৰ্ব্বপ্রথমে জানিতে পারিয়াছে। তাই গুরু হিসাবে, অগ্রপথিক হিসাবে এবং সত্যের অবিচল সেবক হিসাবে, তাঁহার প্রতি অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াই আজ ক্ষান্ত হইতেছি।