চাপা ক্রন্দনে অপগতাকে সকাতর আহ্বান, মাতৃশােকাতুরা নিজের দুঃখেই যথেষ্ট অভিভূত হইয়া আছে, তার উপর বাপের এতখানি কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে অসহনীয় মনে হইত। অথচ নিজের কষ্ট ভুলিয়া তাঁকেই একান্ত স্নেহে ও শ্রদ্ধায় নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিয়া থাকিত। বি-এ পরীক্ষার পর এম-এ পড়িবার যে কল্পনা ছিল, সে ইচ্ছা তাঁর জন্য সে ত্যাগ করিল, অসহায় শােকাচ্ছন্ন বাপকে সে কার কাছে রাখিয়া দিয়া কলিকাতায় পড়িতে যাইবে!
সকল দেশেই প্রবাদ আছে, ‘অতির গতি ভাল নয়’ ‘অতি দর্প হতা লঙ্কা’ ইত্যাদি, এক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিল! চন্দ্রকুমারের অতি শোক তাঁর অতিশয় পতনেরই কারণ হইয়া দাঁড়াইল। সহায়তা ভিন্ন শাস্ত্রাধ্যায়ন অতি সাধারণ বুদ্ধিতে তার সত্যমূর্ত্তিতে প্রকটিত হয় না, ঝোঁকের মাথায় পুঁথির পাতা উল্টাইয়া যাওয়াই চলে, চিত্তক্ষেত্রে ধর্ম্মের বীজ যথাযথ ভাবে অঙ্কুরিত হইয়া পল্লবিত ও পুষ্প-প্রসবিনী ফলপ্রসূ হইতে পারে না।
কিছুদিন পরে একান্ত নিরসবােধে শাস্ত্রচর্চ্চা ছাড়িয়া দিয়া চন্দ্রকুমার সাইকীক সােসাইটিতে যাতায়াত আরম্ভ করিলেন। ‘লেড বিটার’, ‘অলিভার লজ’, ‘ম্যাডাম, ব্ল্যাভাটস্কি’ ও অন্যান্য কিছু কিছু পরলােকতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থাদি একান্ত আগ্রহে সংগ্রহ ও পাঠ করিতে লাগিলেন, মনে হইল বুঝি এইবার একটা শান্তির সন্ধান পাইয়াছেন! ইহলােকের ও পরলােকের মাঝখানে যে একটা অতি গুহ্য এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ম মিলন-সেতু এই উভয় লােকের অধিবাসীদের একান্তরূপে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে, এইবার সেই গুপ্ত পথের সন্ধান লাভ করিয়া তিনি বুঝি সেই সেতুটাকে পার হইতে পারিয়াছেন! আর কি? এখন তাঁর প্রবাসিনী-প্রিয়া আর তাঁর অনধিগম্যা রহিলেন না, তাঁর অন্তরের নাস্তিত্বের শূন্যতা এইবার সম্পূর্ণরূপে দূর হইয়া গেল!