পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৭৪
গল্পগুচ্ছ

এতে পরিহাসের কড়া স্বাদ নেই। সেইজন্য ইদানীং নীহারের হঠাৎ সংস্কৃত আবৃত্তিকে ভালো লাগাবার চেষ্টা করত।

 এমন সময়ে একটা ঘটনা ঘটল যাতে ছাত্রছাত্রীদের মিলেমিশে কাজ করবার একটা সুযোগ হল। সর্বন ইউনিভার্সিটির একজন ভারতপ্রত্নতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিত আসবেন কলকাতা ইউনিভার্সিটির নিমন্ত্রণে। ছেলেমেয়েরা ঠিক করেছিল পথের মধ্যে থেকে তারাই তাঁকে অভ্যর্থনা করার গৌরব সর্বপ্রথমে লুটে নেবে। আগে ভাগে অধ্যাপকের কাছে গিয়ে তাঁকে ওদের প্রগতিসংঘের নিমন্ত্রণ জানালে। তিনি ফরাসী সৌজন্যের আতিশয্যে এই নিমন্ত্রণ স্বীকার করে নিলেন। তার পরে কে তাঁর অভিনন্দন পাঠ করবে, সেটা ওরা ভালো করে ভেবে পাচ্ছিল না। কেউ বলছিল সংস্কৃত ভাষায় বলবে, কেউ বলছিল ইংরেজি ভাষাই যথেষ্ট—কিন্তু তা কারও মনঃপূত হল না। ফরাসী পণ্ডিতকে ফরাসী ভাষায় সম্মান প্রকাশ করাই উপযুক্ত ঠিক করল। কিন্তু করবে কে। বাইরের লোক পাওয়া যায়, কিন্তু সেটাতে তো সম্মান রক্ষা হয় না। এমন সময়ে নীহাররঞ্জন বলে উঠল, “আমার উপর যদি ভার দাও, আমি কাজ চালিয়ে নিতে পারব এবং ভালো রকমেই পারব।”

 মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল যাদের নীহাররঞ্জনের উপর বিশেষ টান, তারা বললে— দেখা যাক্-না।

 সুরীতির বিশেষ আপত্তি, সে বললে— একটা ভাঁড়ামি হয়ে উঠবে।

 দলের মেয়েরা বললে, “আমরা বিদেশী, যদি বা আমাদের ভাষায় কিংবা বক্তৃতায় কোনো ত্রুটি হয় তা ফরাসী অধ্যাপক নিশ্চয়ই হাসিমুখে মেনে নেবেন। ওঁরা তো আর ইংরেজ নন, ইংরেজরা বিদেশীদের কাছ থেকেও নিজেদের আদবকায়দার স্খলন সইতে পারেন না, এমন ওঁদের অহংকার। কিন্তু ফরাসীদের তা নয়, বরঞ্চ যদি কিছু অসম্পূর্ণ থাকে সেটা হেসে গ্রহণ করবে। দেখা যাক্-না—নীহাররঞ্জনের বিদ্যের দৌড় কতদূর। শুনেছি ও ঘরে বসে বসে ফরাসী পড়ার চর্চা করে।”

 নীহাররঞ্জনের বাড়ি চন্দননগরে। প্রথম বয়সে ফরাসী স্কুলে তার বিদ্যাশিক্ষা, সেখানে ওর ভাষার দখল নিয়ে খুব খ্যাতি পেয়েছিল, এ-সব কথা ওর কলকাতার বন্ধু-মহল কেউ জানত না। যা হোক, সে তো কোমর বেঁধে দাঁড়ালো। কী আশ্চর্য, অভিনন্দন যখন পড়ল তার ভাষার ছটায় ফরাসী পণ্ডিত এবং তাঁর দু-একজন অনুচর আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তাঁরা বললেন— এ রকম মার্জিত ভাষা ফ্রান্সের বাইরে কখনো শোনেন নি। বললেন, এ ছেলেটির উচিত প্যারিসে গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে আসা। তার পর থেকে ওদের কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলীতে ধন্য ধন্য রব উঠল; বললে— কলেজের নাম রক্ষা হল, এমন-কি কলকাতা ইউনিভার্‌সিটিকেও ছাড়িয়ে গেল খ্যাতিতে।

 এর পরে নীহারকে অবজ্ঞা করা কারও সাধ্যের মধ্যে রইল না। ‘নীহারদা’ ‘নীহারদা’ গঞ্জনধ্বনিতে কলেজ মুখরিত হয়ে উঠল। প্রগতিসংঘের প্রথম নিয়মটা আর টেকে না। পুরুষদের মন ভোলাবার জন্য রঙিন কাপড়-চোপড় পরা ওরা ত্যাগ করেছিল। সব-প্রথমে সে নিয়মটি ভাঙল সুরীতি, রঙ লাগালো তার আঁচলায়। আগেকার বিরুদ্ধ ভাব কাটিয়ে নীহাররঞ্জনের কাছে ঘেঁষতে তার সংকোচ বোধ হতে লাগল, কিন্তু সে সংকোচ বুঝি টেকে না।