পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শেষ কথা
৮১৯

হবে, তোমার লাইব্রেরি বেচে তাঁর গয়না বানিয়ে দেবে, আমি দেব লম্বা দৌড়। অত্যন্ত অহংকার না বাড়লে এ কথা তোমাকে মানতেই হবে, আমাকে না হলে একদিনও তোমার চলে না। আমার অনুপস্থিতিতে পনেরোই আশ্বিনকে পনেরোই অক্টোবর বলে তোমার ধারণা হয়, যেদিন বাড়িতে তোমার সহযোগী অধ্যাপকের নিমন্তন্ন সেইদিনই লাইব্রেরিঘরে দরজা বন্ধ করে নিদারূণ একটা ইকোয়েশন করতে লেগে যাও। গাড়িতে চড়ে ড্রাইভরকে যে ঠিকানা দাও সে ঠিকানায় আজও বাড়ি তৈরি হয় নি। নবীনবাবু মনে করছেন আমি অত্যুক্তি করছি।”

 আমি বললুম, “একেবারেই না। কিছুদিন তো ওঁকে দেখছি, তার থেকেই অসন্দিগ্ধ বুঝেছি, আপনি যা বলছেন তা খাঁটি সত্য।”

 “আজ এত অলুক্ষণে কথা তোমার মুখ দিয়ে বেরচ্ছে কেন। জান নবীন?—এই রকম যা-তা বলবার উপসর্গ ওর সম্প্রতি দেখা দিয়েছে।”

 “সব লক্ষণ শান্ত হয়ে যাবে, তুমি চলো দেখি তোমার কাজে। নাড়ি আবার ফিরে আসবে। থামবে প্রলাপ-বকুনি।”

 অধ্যাপক আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার কী পরামর্শ নবীন।”

 উনি পণ্ডিত মানুষ বলেই জিয়লজিস্টের বৃদ্ধির ’পরে ওঁর এত শ্রদ্ধা। আমি একটুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললুম, “অচিরাদেবীর চেয়ে সত্য পরামর্শ আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।”

 অচিরা উঠে দাঁড়িরে পা ছুঁয়ে আমাকে প্রণাম করলে। আমি সংকুচিত হয়ে পিছু হটে গেলুম। অচিরা বললে, “সংকোচ করবেন না, আপনার তুলনায় আমি কেউ নই। সে কথাটা একদিন স্পষ্ট হবে। এইখানেই শেষ বিদায় নিলুম। যাবার আগে আর কিন্তু দেখা হবে না।”

 অধ্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন, “সেকি কথা দিদি!”

 “দাদু, তুমি অনেক কিছু জান, কিন্তু অনেক কিছু সম্বন্ধে তোমার চেয়ে আমার বুদ্ধি অনেক বেশি সবিনয়ে এ কথাটা স্বীকার করে নিয়ো।”

 আমি পদধূলি নিয়ে প্রণাম করলুম অধ্যাপককে। তিনি আমাকে বুকে আলিঙ্গন করে ধরে বললেন, “আমি জানি সামনে তোমার কীর্তির পথ প্রশস্ত।”


এইখানে আমার ছোটো গল্প ফুরল। তার পরেকার কথা জিয়লজিস্টের। বাড়ি ফিরে গিয়ে কাজের নোট এবং রেকর্ড গুলো আবার খুললাম। মনে হঠাৎ খুব একটা আনন্দ জাগল— বুঝলুম একেই বলে মুক্তি। সন্ধ্যাবেলায় দিনের কাজ শেষ করে বারান্দায় এসে বোধ হল— খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছে পাখি, কিন্তু পায়ে আছে এক টুকরো শিকল। নড়তে চড়তে সেটা বাজে।

 ৪.১০.৩৯
ফাল্গুন ১৩৪৬