পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬২৪
গল্পগুচ্ছ

ছুটিয়া চলিয়াছে—এই কথা ভাবিতে ভাবিতে রসিক একদৃষ্টে জলের স্রোতের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল; বোধ করি তাহার মনে হইতেছিল, দুর্বহ মানবজন্মটাকে এই বন্ধনহীন নিশ্চিন্ত জলধারার সঙ্গে মিশাইয়া ফেলিতে পারিলেই একমাত্র শান্তি।
 এমন সময় একজন তরুণ যুবক মাথা হইতে একটা বস্তা নামাইয়া তাহার পাশে বসিয়া কোঁচার প্রান্ত হইতে চিঁড়া খুলিয়া লইয়া ভিজাইয়া খাইবার উদ্যোগ করিল। এই লোকটিকে দেখিয়া রসিকের কিছু নূতন রকমের ঠেকিল। পায়ে জুতা নাই, ধুতির উপর একটা জামা, মাথায় পাগড়ি পরা—দেখিবামাত্র স্পষ্ট মনে হয়, ভদ্র-লোকের ছেলে—কিন্তু মুটে-মজুরের মতো কেন যে সে এমন করিয়া বস্তা বহিয়া বেড়াইতেছে ইহা সে বুঝিতে পারিল না। দুইজনের আলাপ হইতে দেরি হইল না এবং রসিক ভিজা চিঁড়ার যথোচিত পরিমাণে ভাগ লইল। এ ছেলেটি কলিকাতার কলেজের ছাত্র। ছাত্রেরা যে স্বদেশী কাপড়ের দোকান খুলিয়াছে তাহারই জন্য দেশি কাপড় সংগ্রহ করিতে সে এই গ্রামের হাটে আসিয়াছে। নাম সুবোধ, জাতিতে ব্রাহ্মণ। তাহার কোনো সংকোচ নাই, বাধা নাই—সমস্তদিন হাটে ঘুরিয়া সন্ধ্যাবেলায় চিঁড়া ভিজাইয়া খাইতেছে।
 দেখিয়া নিজের সম্বন্ধে রসিকের ভারি একটা লজ্জা বোধ হইল। শুধু তাই নয়, তাহার মনে হইল ‘যেন মুক্তি পাইলাম’। এমন করিয়া খালি পায়ে মজুরের মতো যে মাথায় মোট বহিতে পারা যায় ইহা উপলব্ধি করিয়া জীবনযাত্রার ক্ষেত্র এক মুহূর্তে তাহার সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল। সে ভাবিতে লাগিল, ‘আজ তো আমার উপবাস করিবার কোনো দরকারই ছিল না—আমি তো ইচ্ছা করিলেই মোট বহিতে পারিতাম।’
 সুবোধ যখন মোট মাথায় লইতে গেল রসিক বাধা দিয়া বলিল, “মোট আমি বহিব।” সুবোধ তাহাতে নারাজ হইলে রসিক কহিল, “আমি তাঁতির ছেলে, আমি আপনার মোট বহিব, আমাকে কলিকাতায় লইয়া যান।” ‘আমি তাঁতি’, আগে হইলে রসিক এ কথা কখনোই মুখে উচ্চারণ করিতে পারিত না—তাহার বাধা কাটিয়া গেছে।
 সুবোধ তো লাফাইয়া উঠিল; বলিল, “তুমি তাঁতি! আমি তো তাঁতি খুঁজিতেই বাহির হইয়াছি। আজকাল তাহাদের দর এত বাড়িয়াছে যে, কেহই আমাদের তাঁতের স্কুলে শিক্ষকতা করিতে যাইতে রাজি হয় না।”
 রসিক তাঁতের স্কুলের শিক্ষক হইয়া কলিকাতায় আসিল। এত দিন পরে বাসা-খরচ বাদে সে সামান্য কিছু জমাইতে পারি, কিন্তু বাইসিকলচক্রের লক্ষ্য ভেদ করিতে এখনো অনেক বিলম্ব আছে। আর, বধূর বরমাল্যের তো কথাই নাই!—ইতিমধ্যে তাঁতের স্কুলটা গোড়ায় যেমন হঠাৎ জ্বলিয়া উঠিয়াছিল তেমনি হঠাৎ নিবিয়া যাইবার উপক্রম হইল। কমিটির বাবুরা যতক্ষণ কমিটি করিতে থাকেন অতি চমৎকার হয়, কিন্তু কাজ করিতে নামিলেই গণ্ডগোল বাধে; তাঁহারা নানা দিগ্দেশ হইতে নানা প্রকারের তাঁত আনাইয়া শেষকালে এমন একটা অপরূপ জঞ্জাল বুনিয়া তুলিলেন যে, সমস্ত ব্যাপারটা লইয়া যে কোন্ আবর্জনাকুণ্ডে ফেলা যাইতে পারে তাহা কমিটির পর কমিটি করিয়াও স্থির করিতে পারিলেন না।
 রসিকের আর সহ্য হয় না। ঘরে ফিরিবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া