সেই বাক্সটা খুলিয়া তাহার মধ্যে কাগজ ঘাঁটিতে লাগিল। তাহার মধ্যে হিসাবের খাতা এবং তাহারই জোগাড়ের সমস্ত নথি। বাক্স উপুড় করিয়া ঝাড়িয়া কিছুই মিলিল না।
রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বনােয়ারি কহিল, “তুমি চাঁপাতলায় গিয়াছিলে?”
নীলকণ্ঠ বলিল, “আজ্ঞা হাঁ, গিয়াছিলাম বই-কি। দেখিলাম, আপনি ব্যস্ত হইয়া ছুটিতেছেন, কী হইল তাহাই জানিবার জন্য বাহির হইয়াছিলাম।”
বনােয়ারি। আমার রুমালে-বাঁধা কাগজগুলা তুমিই লইয়াছ।
নীলকণ্ঠ নিতান্ত ভালােমানুষের মতাে কহিল, “আজ্ঞা, না।”
বনােয়ারি। মিথ্যা কথা বলিতেছ। তােমার ভালাে হইবে না, এখনি ফিরাইয়া দাও।
বনােয়ারি মিথ্যা তর্জন গর্জন করিল। কী জিনিস তাহার হারাইয়াছে তাহাও সে বলিতে পারিল না এবং সেই চোরাই মাল সম্বন্ধে তাহার কোনাে জোর নাই জানিয়া সে মনে মনে অসাবধান মূঢ় আপনাকেই যেন ছিন্ন ছিন্ন করিতে লাগিল।
কাছারিতে এইরূপ পাগলামি করিয়া সে চাঁপাতলায় আবার খোঁজাখুঁজি করিতে লাগিল। মনে মনে মাতৃদিব্য করিয়া সে প্রতিজ্ঞা করিল, ‘যে করিয়া হউক এ কাগজগুলা পুনরায় উদ্ধার করিব তবে আমি ছাড়িব।’ কেমন করিয়া উদ্ধার করিবে তাহা চিন্তা করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না, কেবল ক্রুদ্ধ বালকের মতাে বারবার মাটিতে পদাঘাত করিতে করিতে বলিল, ‘উদ্ধার করিবই, করিবই, করিবই।
শ্রান্তদেহে সে গাছতলায় বসিল। কেহ নাই, তাহার কেহ নাই এবং তাহার কিছুই নাই। এখন হইতে নিঃসম্বলে আপন ভাগ্যের সঙ্গে এবং সংসারের সঙ্গে তাহাকে লড়াই করিতে হইবে। তাহার পক্ষে মানসম্ভ্রম নাই, ভদ্রতা নাই, প্রেম নাই, স্নেহ নাই, কিছুই নাই। আছে কেবল মরিবার এবং মারিবার অধ্যবসায়।
এইরূপ মনে মনে ছট্ফট্ করিতে করিতে নিরতিশয় ক্লান্তিতে চাতালের উপর পড়িয়া কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যখন জাগিয়া উঠিল তখন হঠাৎ বুঝতে পারিল না কোথায় সে আছে। ভালাে করিয়া সজাগ হইয়া উঠিয়া বসিয়া দেখে, তাহার শিয়রের কাছে হরিদাস বসিয়া। বনােয়ারিকে জাগিতে দেখিয়া হরিদাস বলিয়া উঠিল, “জ্যাঠামশায়, তােমার কী হারাইয়াছে বলাে দেখি।”
বনােয়ারি স্তব্ধ হইয়া গেল। হরিদাসের এ প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিল না। হরিদাস কহিল, “আমি যদি দিতে পারি আমাকে কী দিবে।”
বনােয়ারির মনে হইল, হয়তাে আর-কিছু। সে বলিল, “আমার যাহা আছে সব তােকে দিব।”
এ কথা সে পরিহাস করিয়াই বলিল; সে জানে, তাহার কিছুই নাই।
তখন হরিদাস আপন কাপড়ের ভিতর হইতে বনােয়ারির রুমালে-মােড়া সেই কাগজের তাড়া বাহির করিল। এই রঙিন রুমালটাতে বাঘের ছবি আঁকা ছিল; সেই ছবি তাহার জ্যাঠা তাহাকে অনেকবার দেখাইয়াছে। এই রুমালটার প্রতি হরিদাসের বিশেষ লােভ। সেইজন্যই অগ্নিদাহের গােলমালে ভৃত্যেরা যখন বাহিরে ছুটিয়াছিল সেই অবকাশে বাগানে আসিয়া হরিদাস চাঁপাতলায় দূর হইতে এই রুমালটা দেখিয়াই চিনিতে পারিয়াছিল।