পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৫৬
গল্পগুচ্ছ

করিবার সাহস বা অভ্যাস আমার ছিল না। সেদিন থাকিতে পারিলাম না। লজ্জার মাথা খাইয়া তাঁহাকে বলিয়া বসিলাম, “বউয়ের শরীর ভালো নয়, তাহাকে একবার বাপের কাছে পাঠাইলে হয়।”

 বাবা তো একেবারে হতবুদ্ধি। মনে লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই এইরূপ অভূতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে প্রবর্তিত করিয়াছে। তখনই তিনি উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলি বউমা, তোমার অসুখটা কিসের।”

 হৈম বলিল, “অসুখ তো নাই।”

 বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ দেখাইবার জন্য।

 কিন্তু, হৈমর শরীরও যে দিনে দিনে শুকাইয়া যাইতেছিল তাহা আমরা প্রতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই। একদিন বনমালীবাব তাহাকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, “অ্যাঁ, এ কী। হৈমী, এ কেমন চেহারা তোর! অসুখ করে নাই তো?”

 হৈম কহিল, “না।”

 এই ঘটনার দিন-দশেক পরেই, বলা নাই, কহা নাই, হঠাৎ আমার শ্বশুর আসিয়া উপস্থিত। হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চয় বনমালীবাবু তাঁহাকে লিখিয়াছিলেন।

 বিবাহের পর বাপের কাছে বিদায় লইবার সময় মেয়ে আপনার অশ্রু চাপিয়া নিয়াছিল। এবার মিলনের দিন বাপ যেমনি তাহার চিবুক ধরিয়া মুখটি তুলিয়া ধরিলেন অমনি হৈমর চোখের জল আর মানা মানিল না। বাপ একটি কথা বলিতে পারিলেন না; জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিলেন না 'কেমন আছিস'। আমার শ্বশুর তাঁহার মেয়ের মুখে এমন-একটা কিছু দেখিয়াছিলেন যাহাতে তাঁহার বুক ফাটিয়া গেল।

 হৈম বাবার হাত ধরিয়া তাঁহাকে শোবার ঘরে লইয়া গেল। অনেক কথা যে জিজ্ঞাসা করিবার আছে। তাহার বাবারও যে শরীর ভালো দেখাইতেছে না!

 বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বুড়ি, আমার সঙ্গে যাবি?”

 হৈম কাঙালের মতো বলিয়া উঠিল, “যাব।”

 বাপ বলিলেন, “আচ্ছা, সব ঠিক করিতেছি।”

 শ্বশুর যদি অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হইয়া না থাকিতেন তাহা হইলে এ বাড়িতে ঢুকিয়াই বুঝিতে পারিতেন, এখানে তাঁহার আর সে দিন নাই। হঠাৎ তাঁহার আবির্ভাবকে উপদ্রব মনে করিয়া বাবা তো ভালো করিয়া কথাই কহিলেন না। আমার শ্বশুরের মনে ছিল তাঁহার বেহাই একদা তাঁহাকে বারবার করিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, যখন তাঁহার খুশি মেয়েকে তিনি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিবেন। এ সত্যের অন্যথা হইতে পারে সে কথা তিনি মনেও আনিতে পারেন নাই।

 বাবা তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, “বেহাই, আমি তো কিছু বলিতে পারি না, একবার তা হলে বাড়ির মধ্যে -

 বাড়ির-মধ্যের উপর বরাত দেওয়ার অর্থ কী আমার জানা ছিল। বুঝিলাম, কিছু হইবে না। কিছু হইলও না।

 বউমার শরীর ভালো নাই! এত বড়ো অন্যায় অপবাদ!

 শ্বশুরমশায় স্বয়ং একজন ভালো ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন। ডাক্তার বলিলেন, “বায়ু-পরিবর্তন আবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো হইতে পারে।”

 বাবা হাসিয়া কহিলেন, “হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো তো সকলেরই হইতে পারে।