বােষ্টমী কহিল, “সেটা আমি বুঝয়াছি, তাই তাে তােমার কাছে আসিয়া বসিলাম।”
যাইবার সময় সে আমার পায়ের ধুলা লইতে গিয়া, দেখিলাম, আমার মােজাতে হাত ঠেকিয়া তাহার বড়াে বাধা বােধ হইল।
পরের দিন ভােরে সূর্য উঠিবার পূর্বে আমি ছাদে আসিয়া বসিয়াছি। দক্ষিণে বাগানের ঝাউগাছগুলার মাথার উপর দিয়া একেবারে দিকসীমা পর্যন্ত মাঠ ধূ ধূ করিতেছে। পূর্বদিকে বাঁশবনে-ঘেরা গ্রামের পাশে আখের খেতের প্রান্ত দিয়া প্রতিদিন আমার সামনে সূর্য উঠে। গ্রামের রাস্তাটা গাছের ঘন ছায়ার ভিতর হইতে হঠাৎ বাহির হইয়া খােলা মাঠের মাঝখান দিয়া বাঁকিয়া বহুদূরের গ্রামগুলির কাজ সারিতে চলিয়াছে।
সূর্য উঠিয়াছে কি না জানি না। একখানি শুভ্র কুয়াশার চাদর বিধবার ঘােমটার মতাে গ্রামের গাছগুলির উপর টানা রহিয়াছে। দেখিতে পাইলাম বােষ্টমী সেই ভােরের ঝাপসা আলাের ভিতর দিয়া একটি সচল কুয়াশার মূর্তির মতাে করতাল বাজাইয়া হরিনাম গান করিতে করিতে সেই পুব দিকের গ্রামের সমুখ দিয়া চলিয়াছে।
তন্দ্রাভাঙা চোখের পাতার মতাে এক সময়ে কুয়াশাটা উঠিয়া গেল এবং ঐ-সমস্ত মাঠের ও ঘরের নানা কাজকর্মের মাঝখানে শীতের রৌদ্রটি গ্রামের ঠাকুরদাদার মতাে আসিয়া বেশ করিয়া জমিয়া বসিল।
আমি তখন সম্পাদকের পেয়াদা বিদায় করিবার জন্য লিখিবার টেবিলে আসিয়া বসিয়াছি। এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দের সঙ্গে একটা গানের সুর শােনা গেল। বােষ্টমী গুন্গুন্ করিতে করিতে আসিয়া আমাকে প্রণাম করিয়া কিছু দূরে মাটিতে বসিল। আমি লেখা হইতে মুখ তুলিলাম।
সে বলিল, “কাল আমি তােমার প্রসাদ পাইয়াছি।”
আমি বলিলাম, “সে কী কথা।”
সে কহিল, “কাল সন্ধ্যার সময় কখন তােমার খাওয়া হয় আমি সেই আশায় দরজার বাহিরে বসিয়া ছিলাম। খাওয়া হইলে চাকর যখন পাত্র লইয়া বাহিরে আসিল তাহাতে কী ছিল জানি না কিন্তু আমি খাইয়াছি।”
আমি আশ্চর্য হইলাম। আমার বিলাত যাওয়ার কথা সকলেই জানে। সেখানে কী খাইয়াছি না-খাইয়াছি তাহা অনুমান করা কঠিন নহে, কিন্তু গােবর খাই নাই। দীর্ঘকাল মাছমাংসে আমার রুচি নাই বটে কিন্তু আমার পাচকটির জাতিকুলের কথাটা প্রকাশ্য সভায় আলােচনা না করাই সংগত। আমার মুখে বিস্ময়ের লক্ষণ দেখিয়া বােষ্টমী বলিল, “যদি তােমার প্রসাদ খাইতেই না পারি তবে তােমার কাছে আসিবার তাে কোনাে দরকার ছিল না।”
আমি বলিলাম, “লােকে জানিলে তােমার উপর তাে তাদের ভক্তি থাকিবে না।”
সে বলিল, “আমি তাে সকলকেই বলিয়া বেড়াইতেছি। শুনিয়া উহারা ভাবিল, আমার এইরকমই দশা।”
বােষ্টমী যে সংসারে ছিল, উহার কাছে তাহার খবর বিশেষ কিছু পাইলাম না। কেবল এইটুকু শুনিয়াছি, তাহার মায়ের অবস্থা বেশ ভালাে এবং এখনাে তিনি