ভাইরা তাকে এমন একটি কোণও ছেড়ে দিতে চায় নি যে কোণে একটা অনাবশ্যক জিনিস পড়ে থাকতে পারে। অনাবশ্যক আবর্জনা ঘরের আশে-পাশে অনায়াসে স্থান পায়, কেননা মানুষ তাকে ভুলে যায়; কিন্তু অনাবশ্যক মেয়েমানুষ যে একে অনাবশ্যক আবার তার উপরে তাকে ভােলাও শক্ত, সেইজন্য আঁস্তাকুড়েও তার স্থান নেই। অথচ বিন্দুর খুড়তুতাে ভাইরা যে জগতে পরমাবশ্যক পদার্থ তা বলবার জো নেই। কিন্তু, তারা বেশ আছে।
তাই, বিন্দুকে যখন আমার ঘরে ডেকে আনলুম তার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। তার ভয় দেখে আমার বড়াে দুঃখ হল। আমার ঘরে যে তার একটুখানি জায়গা আছে সেই কথাটি আমি অনেক আদর করে তাকে বুঝিয়ে দিলাম।
কিন্তু, আমার ঘর শুধু তাে আমারই ঘর নয়। কাজেই আমার কাজটি সহজ হল না। দু-চারদিন আমার কাছে থাকতেই তার গায়ে লাল লাল কী উঠল। হয়তাে সে ঘামাচি, নয় তাে আর-কিছু হবে; তােমরা বললে বসন্ত। কেননা, ও যে বিন্দু। তােমাদের পাড়ার এক আনাড়ি ডাক্তার এসে বললে, আর দুই-একদিন না গেলে ঠিক বলা যায় না। কিন্তু, সেই দুই-একদিনের সবুর সইবে কে। বিন্দু তাে তার ব্যামাের লজ্জাতেই মরবার জো হল। আমি বললাম, বসন্ত হয় তাে হােক্, আমি আমাদের সেই আঁতুড়ঘরে ওকে নিয়ে থাকব, আর কাউকে কিছু করতে হবে না। এই নিয়ে আমার উপরে তােমরা যখন সকলে মারমূর্তি ধরেছ, এমন-কি বিন্দুর দিদিও যখন অত্যন্ত বিরক্তির ভান করে পােড়াকপালি মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাবার প্রস্তাব করছেন, এমন সময় ওর গায়ের সমস্ত লাল দাগ একদম মিলিয়ে গেল। তােমরা দেখি তাতে আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলে। বললে, নিশ্চয়ই বসন্ত বসে গিয়েছে। কেননা, ও যে বিন্দু।
অনাদরে মানুষ হবার একটা মস্ত গুণ, শরীরটাকে তাতে একেবারে অজর অমর করে তােলে। ব্যামাে হতেই চায় না; মরার সদর রাস্তাগুলাে একেবারেই বন্ধ। রােগ তাই ওকে ঠাট্টা করে গেল; কিছুই হল না। কিন্তু, এটা বেশ বােঝা গেল, পৃথিবীর সব চেয়ে অকিঞ্চিৎকর মানুষকে আশ্রয় দেওয়াই সব চেয়ে কঠিন। আশ্রয়ের দরকার তার যত বেশি আশ্রয়ের বাধাও তার তেমনি বিষম।
আমার সম্বন্ধে বিন্দুর ভয় যখন ভাঙল তখন ওকে আর-এক গেরোয় ধরল। আমাকে এমনি ভালােবাসতে শুরু করলে যে আমাকে ভয় ধরিয়ে দিলে। ভালােবাসার এরকম মতি সংসারে তাে কোনােদিন দেখি নি। বইয়েতে পড়েছি বটে, সেও মেয়েপুরুষের মধ্যে। আমার যে রূপ ছিল সে কথা আমার মনে করবার কোনাে কারণ বহুকাল ঘটে নি—এত দিন পরে সেই রূপটা নিয়ে পড়ল এই কুশ্রী মেয়েটি। আমার মুখ দেখে তার চোখের আশ আর মিটত না। বলত, “দিদি, তােমার এই মুখখানি আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় নি।” যেদিন আমি নিজের চুল নিজে বাঁধতুম সেদিন তার ভারি অভিমান। আমার চুলের বােঝা দুই হাত দিয়ে নাড়তে-চাড়তে তার ভারি ভালাে লাগত। কোথাও নিমন্ত্রণে যাওয়া ছাড়া আমার সাজগােজের তাে দরকার ছিল না। কিন্তু, বিন্দু আমাকে অস্থির করে রােজই কিছু-না-কিছু সাজ করাত। মেয়েটা আমাকে নিয়ে একেবারে পাগল হয়ে উঠল।
তােমাদের অন্দরমহলে কোথাও জমি এক ছটাক নেই। উত্তর দিকের পাঁচিলের