আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল; বললে, “দিদি, আমার আবার বিয়ে করা কেন।”
আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম, “বিন্দু তুই ভয় করিস নে—শুনেছি তাের বর ভালাে।”
বিন্দু বললে, “বর যদি ভালাে হয়, আমার কী আছে যে আমাকে তার পছন্দ হবে।”
বরপক্ষেরা বিন্দুকে তাে দেখতে আসবার নামও করলে না। বড়দিদি তাতে বড়ো নিশ্চিন্ত হলেন।
কিন্তু, দিনরাত্রে বিন্দুর কান্না আর থামতে চায় না। সে তার কী কষ্ট, সে আমি জানি। বিন্দুর জন্যে আমি সংসারে অনেক লড়াই করেছি, কিন্তু ওর বিবাহ বন্ধ হােক এ কথা বলবার সাহস আমার হল না। কিসের জোরেই বা বলব। আমি যদি মারা যাই তাে ওর কী দশা হবে।
একে তাে মেয়ে, তাতে কালাে মেয়ে; কার ঘরে চলল, ওর কী দশা হবে, সে কথা না ভাবাই ভালাে। ভাবতে গেলে প্রাণ কেঁপে ওঠে।
বিন্দ, বললে, “দিদি, বিয়ের আর পাঁচ দিন আছে, এর মধ্যে আমার মরণ হবে কি।”
আমি তাকে খুব ধমকে দিলুম; কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি কোনাে সহজভাবে বিন্দুর মৃত্যু হতে পারত তা হলে আমি আরাম বােধ করতুম।
বিবাহের আগের দিন বিন্দু তার দিদিকে গিয়ে বললে, “দিদি, আমি তােমাদের গােয়ালঘরে পড়ে থাকব, আমাকে যা বলবে তাই করব, তােমার পায়ে পড়ি আমাকে এমন করে ফেলে দিয়াে না।”
কিছুকাল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দিদির চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, সেদিনও পড়ল। কিন্তু, শুধু হৃদয় তাে নয়, শাস্ত্রও আছে। তিনি বললেন, “জানিস তো বিন্দি, পতিই হচ্ছে স্ত্রীলােকের গতি মুক্তি সব। কপালে যদি দুঃখ থাকে তাে কেউ খণ্ডাতে পারবে না।”
আসল কথা হচ্ছে, কোনাে দিকে কোনাে রাস্তাই নেই—বিন্দুকে বিবাহ করতেই হবে, তার পরে যা হয় তা হােক।
আমি চেয়েছিলাম, বিবাহটা যাতে আমাদের বাড়িতেই হয়। কিন্তু, তােমরা বলে বসলে, বরের বাড়িতেই হওয়া চাই—সেটা তাদের কৌলিক প্রথা।
আমি বুঝলুম, বিন্দুর বিবাহের জন্য যদি তােমাদের খরচ করতে হয় তবে সেটা তােমাদের গৃহদেবতার কিছুতেই সইবে না। কাজেই চুপ করে যেতে হল। কিন্তু, একটি কথা তােমরা কেউ জান না। দিদিকে জানাবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু জানাই নি কেননা তা হলে তিনি ভয়েই মরে যেতেন— আমার কিছু কিছু গয়না দিয়ে আমি লুকিয়ে বিন্দুকে সাজিয়ে দিয়েছিলাম। বােধ করি দিদির চোখে সেটা পড়ে থাকবে, কিন্তু সেটা তিনি দেখেও দেখেন নি। দোহাই ধর্মের, সেজন্যে তােমরা তাঁকে ক্ষমা কোরো।
যাবার আগে বিন্দু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, “দিদি, আমাকে তােমরা তা হলে নিতান্তই ত্যাগ করলে?”