আমি বললাম, “না বিন্দি, তাের যেমন দশাই হােক্-না কেন, আমি তােকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করব না।”
তিন দিন গেল। তােমাদের তালুকের প্রজা খাবার জন্যে তােমাকে যে ভেড়া দিয়েছিল তাকে তােমার জঠরাগ্নি থেকে বাঁচিয়ে আমি আমাদের একতলায় কয়লা রাখবার ঘরের এক পাশে বাস করতে দিয়েছিলুম। সকালে উঠেই আমি নিজে তাকে দানা খাইয়ে আসতুম; তােমার চাকরদের প্রতি দুই-একদিন নির্ভর করে দেখেছি, তাকে খাওয়ানাের চেয়ে তাকে খাওয়ার প্রতিই তাদের বেশি ঝোঁক।
সেদিন সকালে সেই ঘরে ঢুকে দেখি, বিন্দু এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখেই আমার পা জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।
বিন্দুর স্বামী পাগল।
“সত্যি বলছিস, বিন্দি?”
“এত বড়াে মিথ্যা কথা তােমার কাছে বলতে পারি, দিদি? তিনি পাগল। শ্বশুরের এই বিবাহে মত ছিল না— কিন্তু, তিনি আমার শাশুড়িকে যমের মতাে ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন। শাশুড়ি জেদ করে তাঁর ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।”
আমি সেই রাশ-করা কয়লার উপর বসে পড়লুম। মেয়েমানুষকে মেয়েমানুষ দয়া করে না। বলে, “ও তাে মেয়েমানুষ বই তাে নয়। ছেলে হােক-না পাগল, সে তাে পুরুষ বটে।
বিন্দুর স্বামীকে হঠাৎ পাগল বলে বােঝা যায় না, কিন্তু এক-একদিন সে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। বিবাহের রাত্রে সে ভালাে ছিল, কিন্তু রাত-জাগা প্রভৃতি উৎপাতে দ্বিতীয় দিন থেকে তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে উঠল। বিন্দু দুপুরবেলায় পিতলের থালায় ভাত খেতে বসেছিল, হঠাৎ তার স্বামী থালাসুদ্ধ ভাত টেনে উঠোনে ফেলে দিলে। হঠাৎ কেমন তার মনে হয়েছে, বিন্দু স্বয়ং রানী রাসমণি; বেহারাটা নিশ্চয় সােনার থালা চুরি করে রানীকে তার নিজের থালায় ভাত খেতে দিয়েছে। এই তার রাগ। বিন্দু তাে ভয়ে মরে গেল। তৃতীয় রাত্রে শাশুড়ি তাকে যখন স্বামীর ঘরে শুতে বললে, বিন্দর প্রাণ শুকিয়ে গেল। শাশুড়ি তার প্রচণ্ড, রাগলে জ্ঞান থাকে না। সেও পাগল, কিন্তু পুরাে নয় বলেই আরও ভয়ানক। বিন্দুকে ঘরে ঢুকতে হল। স্বামী সে রাত্রে ঠাণ্ডা ছিল। কিন্তু, ভয়ে বিন্দুর শরীর যেন কাঠ হয়ে গেল। স্বামী যখন ঘুমিয়েছে অনেক রাত্রে সে অনেক কৌশলে পালিয়ে চলে এসেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ লেখবার দরকার নেই।
ঘণায় রাগে আমার সকল শরীর জ্বলতে লাগল। আমি বললাম, “এমন ফাঁকির বিয়ে বিয়েই নয়। বিন্দু তুই যেমন ছিলি তেমনি আমার কাছে থাক, দেখি তােকে কে নিয়ে যেতে পারে।”
তােমরা বললে, “বিন্দু মিথ্যা কথা বলছে।”
আমি বললাম, “ও কখনাে মিথ্যা বলে নি।”
তােমরা বললে, “কেমন করে জানলে।”
আমি বললাম, “আমি নিশ্চয় জানি।”