সেই মত্যুর বাঁশি এই বালিকার ভাঙা হৃদয়ের ভিতর দিয়ে আমার জীবনের যমুনাপারে যেদিন বাজল সেদিন প্রথমটা আমার বুকের মধ্যে যেন বাণ বিঁধল। বিধাতাকে জিজ্ঞাসা করলুম, জগতের মধ্যে যা-কিছু সব চেয়ে তুচ্ছ তাই সব চেয়ে কঠিন কেন। এই গলির মধ্যকার চারি-দিকে-প্রাচীর-তােলা নিরানন্দের অতি সামান্য বুদ্বুদটা এমন ভয়ংকর বাধা কেন। তােমার বিশ্বজগৎ তার ছয় ঋতুর সুধাপাত্র হাতে ক’রে যেমন করেই ডাক দিক-না কেন, এক মুহূর্তের জন্যে কেন আমি এই অন্দরমহলটার এইটুকু মাত্র চৌকাঠ পেরতে পারি নে। তােমার এমন ভুবনে আমার এমন জীবন নিয়ে কেন ঐ অতি তুচ্ছ ইঁটকাঠের আড়ালটার মধ্যেই আমাকে তিলে তিলে মরতেই হবে। কত তুচ্ছ আমার এই প্রতিদিনের জীবনযাত্রা; কত তুচ্ছ এর সমস্ত বাঁধা নিয়ম, বাঁধা অভ্যাস, বাঁধা বুলি, এর সমস্ত বাঁধা মার—কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দীনতার নাগপাশবন্ধনেরই হবে জিত—আর হার হল তােমার নিজের সৃষ্টি ঐ আনন্দলােকের?
কিন্তু, মত্যুর বাঁশি বাজতে লাগল—কোথায় রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল, কোথায় রে তােমাদের ঘােরো আইন দিয়ে গড়া কাঁটার বেড়া। কোন্ দুঃখে কোন্ অপমানে মানুষকে বন্দী করে রেখে দিতে পারে। ঐ তাে মৃত্যুর হাতে জীবনের জয়পতাকা উড়ছে! ওরে মেজোবউ, ভয় নেই তাের! তাের মেজোবউয়ের খােলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও লাগে না।
তােমাদের গলিকে আর আমি ভয় করি নে। আমার সমুখে আজ নীল সমুদ্র, আমার মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ।
তােমাদের অভ্যাসের অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিল। ক্ষণকালের জন্য বিন্দু এসে সেই আবরণের ছিদ্র দিয়ে আমাকে দেখে নিয়েছিল। সেই মেয়েটাই তার আপনার মৃত্যু দিয়ে আমার আবরণখানা আগাগােড়া ছিন্ন করে দিয়ে গেল। আজ বাইরে এসে দেখি, আমার গৌরব রাখবার আর জায়গা নেই। আমার এই অনাদৃত রূপ যাঁর চোখে ভালাে লেগেছে সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে আমাকে চেয়ে দেখছেন। এইবার মরেছে মেজোবউ।
তুমি ভাবছ আমি মরতে যাচ্ছি—ভয় নেই, অমন পুরােনাে ঠাট্টা তােমাদের সঙ্গে আমি করব না। মীরাবাঈও তাে আমারই মতাে মেয়েমানুষ ছিল—তার শিকলও তাে কম ভারী ছিল না, তাকে তাে বাঁচবার জন্যে মরতে হয় নি। মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল, ‘ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভু—তাতে তার যা হবার তা হােক।’
এই লেগে থাকাই তাে বেঁচে থাকা।
আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলুম।
মৃণাল