পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভাইফোঁটা
৬৮৩

নিজেকে যতই অপরাধী মনে করিত আমি ততই খুশি হইতাম। কড়া শাসনে মানুষের ভালো করিবার সুযোেগ পাইলে, নিজে যে অনেক শাসনে ভালো হইয়াছি সেটার একটা দাম ফিরিয়া পাওয়া যায়। অনুও আমাকে নিজের এবং পৃথিবীর অধিকাংশের তুলনায় অদ্ভুত ভালো বলিয়া জানিত।

 ক্রমে বয়স বাড়িয়াছে, ইকুল হইতে কলেজে গিয়াছি। অখিলবাবুর স্ত্রীর মনে মনে ইচ্ছা ছিল, আমার মতো ভালো ছেলের সঙ্গে অনুর বিবাহ দেন। আমারও মনে এটা ছিল, কোনো কন্যার পিতার চোখ এড়াইবার মতো ছেলে আমি নই। কিন্তু একদিন শুনিলাম বি, এল, পাসকরা একটি টাটকা মুন্‌সেফের সঙ্গে অনুর সম্বন্ধ পাকা হইয়াছে। আমরা গরিব—আমি তো জানিতাম, সেটাতেই আমাদের দাম বাড়িয়াছে। কিন্তু, কন্যার পিতার হিসাবের প্রণালী স্বতন্ত্র।

 বিসর্জনের প্রতিমা ডুবিল। একেবারে জীবনের কোন আড়ালে সে পড়িয়া গেল। শিশুকাল হইতে যে আমার সকলের চেয়ে পরিচিত সে এক দিনের মধ্যেই এই হাজার-লক্ষ অপরিচিত মানুষের সমুদ্রের মধ্যে তলাইয়া গেল। সেদিন মনে যে কী বাজিল তাহা মনই জানে। কিন্তু, বিসর্জনের পরেও কি চিনিয়াছিলাম সে আমার দেবীর প্রতিমা? তা নয়। অভিমান সেদিন ঘা খাইয়া আরও ঢেউ খেলাইয়া উঠিয়াছিল। অনুকে তো চিরকাল ছোটো করিয়াই দেখিয়া আসিয়াছি; সেদিন আমার যোগ্যতার তুলনায় তাকে আরও ছোটো করিয়া দেখিলাম। আমার শ্রেষ্ঠতার যে পূজা হইল না, সেদিন এইটেই সংসারে সকলের চেয়ে বড়ো অকল্যাণ বলিয়া জানিয়াছি।

 যাক, এটা বোঝা গেল, সংসারে শুধু সৎ হইয়া কোনো লাভ নাই। পণ করিলাম এমন টাকা করিব যে একদিন অখিলবাবুকে বলিতে হইবে, ‘বড়ো ঠকান ঠকিয়াছি।’ খুব কষিয়া কাজের লোক হইবার জোগাড় করিলাম।

 কাজের লোক হইবার সব চেয়ে বড়ো সরঞ্জাম নিজের ’পরে অগাধ বিশ্বাস। সে পক্ষে আমার কোনোদিন কোনো কমতি ছিল না। এ জিনিসটা ছোঁয়াচে। যে নিজেকে বিশ্বাস করে অধিকাংশ লোকেই তাকে বিশ্বাস করে। কেজো বুদ্ধিটা যে আমার স্বাভাবিক এবং অসাধারণ সেটা সকলেই মানিয়া লইতে লাগিল।

 কেজো সাহিত্যের বই এবং কাগজে আমার শেল্‌ফ্ এবং টেবিল ভরিয়া উঠিল। বাড়ি-মেরামত, ইলেকট্রিক আলো ও পাখার কৌশল, কোন্ জিনিসের কত দর, বাজারদর ওঠাপড়ার গূঢ়তত্ত্ব, এক্‌স্‌চেঞ্জের রহস্য, প্ল্যান, এস্টিমেট প্রভৃতি বিদ্যায় আসর জমাইবার মতো ওস্তাদি আমি একরকম মারিয়া লইয়াছিলাম।

 কিন্তু, অহরহ কাজের কথা বলি অথচ কিছুতে কোনো কাজেই নামি না, এমনভাবে অনেক দিন কাটিল। আমার ভক্তরা যখনই আমাকে কোনো-একটা স্বদেশী কোম্পানিতে যোগ দিবার প্রস্তাব করিত আমি বুঝাইয়া দিতাম, যতগুলা কারবার চলিতেছে কোনোটার কাজের ধারা বিশুদ্ধ নহে, সকলেরই মধ্যে গলদ বিস্তর—তা ছাড়া, সততা বাঁচাইয়া চলিতে হইলে ওদের কাছে ঘেঁষিবার জো নাই। সততার লাগামে একটু-আধটু ঢিল না দিলে ব্যাবসা চলে না, এমন কথা আমার কোনো বন্ধু বলাতে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে।

 মৃত্যুকাল পর্যন্ত সর্বাঙ্গসুন্দর প্ল্যান এস্টিমেট এবং প্রস্পেক্টস্ লিখিয়া আমার যশ অক্ষয় রাখিতে পারিতাম। কিন্তু, বিধির বিপাকে প্ল্যান করা ছাড়িয়া কাজ