পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮৪
গল্পগুচ্ছ

করায় লাগিলাম। এক তাে পিতার মৃত্যু হওয়াতে আমার ঘাড়েই সংসারের দায় চাপিল; তার পরে আর-এক উপসর্গ আসিয়া জুটিল, সে কথাও বলিতেছি।


প্রসন্ন বলিয়া একটি ছেলে আমার সঙ্গে পড়িত। সে যেমন মুখর তেমনি নিন্দুক। আমাদের পৈতৃক সততার খ্যাতিটাকে লইয়া খোঁচা দিবার সে ভারি সুযোেগ পাইয়াছিল। বাবা আমার নাম দিয়াছিলেন সত্যধন। প্রসন্ন আমাদের দারিদ্র্য লক্ষ্য করিয়া বলিত, “বাবা দিবার বেলা দিলেন মিথ্যাধন, আর নামের বেলা দিলেন সত্যধন, তার চেয়ে ধনটাকে সত্য দিয়া নামটাকে মিথ্যা দিলে লােকসান হইত না।” প্রসন্নর মুখটাকে বড়াে ভয় করিতাম।

 অনেক দিন তার দেখাই ছিল না। ইতিমধ্যে সে বর্মায় লুধিয়ানায় শ্রীরঙ্গপত্তনে নানা রকম-বেরকমের কাজ করিয়া আসিয়াছে। সে হঠাৎ কলিকাতায় আসিয়া আমাকে পাইয়া বসিল। যার ঠাট্টাকে চিরদিন ভয় করিয়া আসিয়াছি তার শ্রদ্ধা পাওয়া কি কম আরাম।

 প্রসন্ন কহিল, “ভাই, আমার এই কথা রইল, দেখে নিয়ো, একদিন তুমি যদি দ্বিতীয় মতি শীল বা দুর্গাচরণ লা’ না হও তবে আমি বউবাজারের মােড় হইতে বাগবাজারের মােড় পর্যন্ত বরাবর সমানে নাকে খত দিতে রাজি আছি।”

 প্রসন্নর মুখে এত বড়ো কথাটা যে কতই বড়াে তাহা প্রসন্নর সঙ্গে যারা এক ক্লাসে না পড়িয়াছে তারা বুঝিতেই পারিবে না। তার উপরে প্রসন্ন পথিবীটাকে খুব করিয়া চিনিয়া আসিয়াছে; উহার কথার দাম আছে।

 সে বলিল, “কাজ বােঝে এমন লােক আমি ঢের দেখিয়াছি দাদা— কিন্তু তারাই সব চেয়ে পড়ে বিপদে। তারা বুদ্ধির জোরেই কিস্তি মাত করিতে চায়, ভুলিয়া যায় যে মাথার উপরে ধর্ম আছেন— কিন্তু তােমাতে যে মণিকাঞ্চনযােগ। ধর্মকেও শক্ত করিয়া ধরিয়াছ, আবার কর্মের বুদ্ধিতেও তুমি পাকা।”

 তখন ব্যাবসা-খ্যাপা কালটাও পড়িয়াছিল। সকলেই স্থির করিয়াছিল, বাণিজ্য ছাড়া দেশের মুক্তি নাই; এবং ইহাও নিশ্চিত বুঝিয়াছিল যে, কেবলমাত্র মূলধনটার জোগাড় হইলেই উকিল মােক্তার ডাক্তার শিক্ষক ছাত্র এবং ছাত্রদের বাপ-দাদা সকলেই এক দিনেই সকলপ্রকার ব্যাবসা পুরাদমে চালাইতে পারে।

 আমি প্রসন্নকে বলিলাম, “আমার সম্বল নাই যে।”

 সে বলিল, “বিলক্ষণ! তােমার পৈতৃক সম্পত্তির অভাব কী।”

 তখন হঠাৎ মনে হইল, প্রসন্ন তবে বুঝি এত দিন ধরিয়া আমার সঙ্গে একটা লম্বা ঠাট্টা করিয়া আসিতেছে।

 প্রসন্ন কহিল, “ঠাট্টা নয় দাদা। সততাই তাে লক্ষ্মীর সােনার পদ্ম। লােকের বিশ্বাসের উপরই কারবার চলে, টাকায় নয়।”

 পিতার আমল হইতেই আমাদের বাড়িতে পাড়ার কোনাে কোনাে বিধবা মেয়ে টাকা গচ্ছিত রাখিত। তারা সুদের আশা করিত না: কেবল এই বলিয়া নিশ্চিত ছিল যে, মেয়েমানুষের সর্বত্রই ঠকিবার আশঙ্কা আছে, কেবল আমাদের ঘরেই নাই।

 সেই গচ্ছিত টাকা লইয়া স্বদেশী এজেন্সি খুলিলাম। কাপড় কাগজ কালী বােতাম সাবান যতই আনাই বিক্রি হইয়া যায়—একেবারে পঙ্গপালের মতাে খরিদ্দার