পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮৮
গল্পগুচ্ছ

চলিলাম। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। এখন হতবুদ্ধির তাড়ায় বৃহস্পতিবারকেও ভয় না করিয়া পারি না। যে মানুষ হতভাগা, নিজের বুদ্ধি ছাড়া আর-কিছুকেই না মানিতে তার ভরসা হয় না। যাবার বেলায় মনটা বড়াে খারাপ হইল।

 অনুর জ্বর বাড়িয়াছে। দেখিলাম, সে বিছানায় শুইয়া। নীচে মেঝের উপর চুপ করিয়া বসিয়া সুবােধ ইংরাজি ছবির কাগজ হইতে ছবি কাটিয়া আটা দিয়া একটা খাতায় আঁটিতেছিল।

 বারবেলা বাঁচাইবার জন্য সময়ের অনেক আগে আসিয়াছিলাম। কথা ছিল, আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে আনিব। কিন্তু, অনুর সম্বন্ধে আমার স্ত্রীর মনের কোণে বােধ করি একটুখানি ঈর্ষা ছিল, তাই সে আসিবার সময় ছুতা করিল, আমিও পীড়াপীড়ি করিলাম না।

 অনু জিজ্ঞাসা করিল, “বউদিদি এলেন না?”

 আমি বলিলাম, “শরীর ভালাে নাই।”

 অনু এক নিশ্বাস ফেলিল, আর কিছু বলিল না।

 আমার মধ্যে একদিন যেটুকু মাধুর্য দেখা দিয়াছিল সেইটিকে আপনার সােনার আলােয় গলাইয়া শরতের আকাশ সেই রােগীর বিছানার উপর বিছাইয়াছিল। কত কথা আজ উঠিয়া পড়িল। সেই-সব অনেক দিনের অতি ছােটো কথা আমার আসন্ন সর্বনাশকে ছাড়াইয়া আজ কত বড়াে হইয়া উঠিল। কারবারের হিসাব ভুলিয়া গেলাম।

 ভাইফোঁটার খাওয়া খাইলাম। আমার কপালে সেই মরণের যাত্রী দীর্ঘায়ুকামনার ফোঁটা পরাইয়া আমার পায়ের ধুলা লইল। আমি গােপনে চোখ মুছিলাম।

 ঘরে আসিয়া বসিলে সে একটি টিনের বাক্স আমার কাছে আনিয়া রাখিল। বলিল, “সুবােধের জন্য এই যা-কিছু, এতদিন আগলাইয়া রাখিয়াছি তােমাকে দিলাম, আর সেই সঙ্গে সুবােধকেও তােমার হাতে দিলাম। এখন নিশ্চিন্ত হইয়া মরিতে পারিব।”

 আমি বলিলাম, “অনু, দোহাই তােমার, টাকা আমি লইব না। সুবােধের দেখাশনার কোনাে ত্রুটি হইবে না, কিন্তু টাকা আর-কারও কাছে রাখিয়াে।”

 অনু কহিল, “এই টাকা লইবার জন্য কত লােক হাত পাতিয়া বসিয়া আছে। তুমি কি তাদের হাতেই দিতে বল।”

 আমি চুপ করিয়া রহিলাম। অনু বলিল, “একদিন আড়াল হইতে শুনিয়াছি, ডাক্তার বলিয়াছে সুবােধের যেরকম শরীরের লক্ষণ ওর বেশিদিন বাঁচার আশা নাই। শুনিয়া অবধি ভয়ে ভয়ে আছি, পাছে আমার মরিতে দেরি হয়। আজ অন্তত আশা লইয়া মরিব যে, ডাক্তারের কথা ভুল হইতেও পারে। সাতচল্লিশ হাজার টাকা কোম্পানির কাগজে জমিয়াছে—আরও কিছু, এ দিকে ও দিকে আছে। ঐ টাকা হইতে সুবােধের পথ্য ও চিকিৎসা ভালাে করিয়াই চলিতে পারিবে। আর, যদি ভগবান অল্প বয়সেই উহাকে টানিয়া লন তবে এই টাকা উহার নামে একটা-কোনাে ভালাে কাজে লাগাইয়াে।”

 আমি কহিলাম, “অনু আমাকে তুমি যত বিশ্বাস কর আমি নিজেকে তত বিশ্বাস করি না।”

 শুনিয়া অনু একটুমাত্র হাসিল। আমার মুখে এমন কথা মিথ্যা বিনয়ের মতাে শোনায়।