পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৯০
গল্পগুচ্ছ

যে, সুবােধের কাছে মুখ দেখানাে আমার দায় হইল। প্রথমটা উহাকে এড়াইতে থাকিলাম, তার পর উহার উপরে বিষম রাগিতে আরম্ভ করিলাম।

 রাগিবার প্রথম উপলক্ষ হইল উহার স্বভাব। আমি নিজে ব্যস্তবাগীশ, সব কাজ তড়িঘড়ি করা আমার অভ্যাস। কিন্তু, সুবােধের কী এক রকমের ভাব, উহাকে প্রশ্ন করিলে হঠাৎ যেন উত্তর করিতেই পারে না—যেখানে সে আছে সেখানে যেন সে নাই, যেন সে আর কোথাও। রাস্তার ধারের জানলার গরাদে ধরিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়া দেয়; কী দেখে, কী ভাবে, তা সেই জানে। আমার এটা অসহ্য বােধ হয়। সুবােধ বহুকাল হইতে রুগ্‌ণ মায়ের কাছে মানুষ, সমবয়সী খেলার সঙ্গী কেউ ছিল না; তাই সে বরাবর আপনার মনকে লইয়াই আপনি খেলা করিয়াছে। এই-সব ছেলের মুশকিল এই যে, ইহারা যখন শােক পায় তখন ভালাে করিয়া কাঁদিতেও জানে না, শােক ভুলিতেও জানে না। এইজন্যই সুবােধকে ডাকিলে হঠাৎ সাড়া পাওয়া যাইত না, এবং কাজ করিতে বলিলে সে ভুলিয়া যাইত। তার জিনিসপত্র সে কেবলই হারাইত, তাহা লইয়া বকিলে চুপ করিয়া মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত যেন সেই চাহিয়া থাকাই তার কান্না। আমি বলিতে লাগিলাম, ‘এর দৃষ্টান্ত যে আমার ছেলের পক্ষে বড়ো খারাপ।’ আবার মুশকিল এই যে, ইহাকে দেখিয়া অবধি নিত্যর ইহাকে ভারি ভালাে লাগিয়াছে; তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম বলিয়াই ইহার প্রতি টানও যেন তার বেশি হইল।

 পরের স্বভাব সংশােধন আমার কৌলিক কাজ; ইহাতে আমার পটুতাও যেমন উৎসাহও তেমনি। সুবােধের স্বভাবটা কর্মপটু নয় বলিয়াই আমি তাকে খুব কষিয়া কাজ করাইতে লাগিলাম। যতবারই সে ভুল করিত ততবারই নিজেকে দিয়া তার সে ভুল শােধরাইয়া লইতাম।

 আবার তার আর-এক অভ্যাস, সেটা তার মায়েরও ছিল—সে আপনাকে এবং আপনার চারি দিককে নানারকম করিয়া কল্পনা করিত। জানলার সামনেই যে জামরুল গাছ ছিল সেটাকে সে কী-একটা অদ্ভুত নাম দিয়াছিল; স্ত্রীর কাছে শুনিয়াছি একলা দাঁড়াইয়া সেই গাছটার সঙ্গে সে কথা কহিত। বিছানাটাকে মাঠ, আর বালিশগুলােকে গােরুর পাল মনে করিয়া শােবার ঘরে বসিয়া রাখালি করাটা যে কত মিথ্যা, ইহা তার নিজের মুখে কবুল করাইবার অনেক চেষ্টা করিয়াছি—সে জবাবই করে না। আমি যতই তাকে শাসন করি আমার কাছে তার ত্রুটি ততই বাড়িয়া চলে। আমাকে দেখিলেই সে থতমত খাইয়া যায়; আমার মুখের সাদা কথাটাও সে বুঝিতে পারে না।

 আর কিছু নয়, হৃদয় যদি রাগ করিতে শুরু করে এবং নিজেকে সামলাইবার মতাে বাহির হইতে কোনাে ধাক্কা যদি সে না পায় তবে রাগটা আপনাকে আপনিই বাড়াইয়া চলে, নূতন কারণের অপেক্ষা রাখে না। যদি এমন মানুষকে দু-চারবার মুখে বলি যার জবাব দিবার সাধ্য নাই তবে সেই দু-চারবার বলাটাই পঞ্চম বারকার বলাটাকে সৃষ্টি করে, কোনাে উপকরণের দরকার হয় না। সুবােধের উপর কেবলই বিরক্ত হইয়া ওঠা আমার মনের এমনি অভ্যাস হইয়াছিল যে, সেটা ত্যাগ করা আমার সাধ্যই ছিল না।

 এমনি করিয়া পাঁচ বছর কাটিল। সুবােধের বয়স যখন বারাে তখন তার