পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৯৬
গল্পগুচ্ছ

 “আচ্ছা, বলো বাবা।”

 “আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতেই কত সময় লাগে। একদিন যখন মনে করতুম আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি। তােমরা তখন—”

 “না বাবা, অমন কথা বােলাে না—আমিও সহ্য করেছি।”

 “মন তাে মাটির ঢেলা নয়, কুড়িয়ে নিলেই তাে নেওয়া যায় না। আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনাে বােঝে নি; কোনাে-একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর—”

 “ঠিক কথা, যতীন।”

 “সেইজন্যেই ওর ছেলেমানুষিতে কোনােদিন কিছু মনে করি নি।”

 মাসি এ কথার কোনাে উত্তর করিলেন না; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাঁট আসিয়াছে তবু ঘরে যায় নাই। কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া; একান্ত ইচ্ছা, মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয়। মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়ােজন করিতেছে। তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে। সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা তিনি জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, ‘বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়াে না—ও একট, চাহিতে শিখুক—মানুষকে একটু কাঁদানাে চাই।’ কিন্তু এসব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বােঝে না। যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, এ কথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আশা পরাভব মানিতেছিল না।

 মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি। তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি, সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতাে— সমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায়। জীবনে কত ভুল করি, কত ভুল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলাে জ্বলে নি। কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে!”

 মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু ঝাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না।

 “আমি ভাবছি মাসি, ওর অল্প বয়স, ও কী নিয়ে থাকবে।”

 “অল্প বয়স কিসের যতীন? এ তো ওর ঠিক বয়স। আমরাও তো বাছা, অল্প বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে ভাসিয়ে অন্তরের মধ্যে বসিয়েছি—তাতে ক্ষতি হয়েছে কী। তাও বলি, সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের।”

 “মাসি, মণির মনটি যেই জাগবার সময় হল অমনি আমি—”

 “ভাব’ কেন, যতীন। মন যদি জাগে তবে সেই কি কম ভাগ্য।”