পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭০০
গল্পগুচ্ছ

 “আমি বেশ জানছি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু, আমার মনে কোনাে খেদ নেই। তুমি আমার জন্য শােক কোরাে না।”

 “না বাবা, আমি শােক করব না। জীবনেই যে মঙ্গল আর মরণে যে নয় এ কথা আমি মনে করি নে।”

 “মাসি, তােমাকে সত্য বলছি, মত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে।”

 অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া যতীন দেখিতেছিল, তাহার মণিই আজ মৃত্যুর বেশ ধরিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে আজ অক্ষয় যৌবনে পূর্ণ—সে গৃহিণী, সে জননী; সে রূপসী, সে কল্যাণী। তাহারই এলােচুলের উপরে ঐ আকাশের তারাগুলি লক্ষ্মীর স্বহস্তের আশীর্বাদের মালা। তাহাদের দুজনের মাথার উপরে এই অন্ধকারের মঙ্গলবস্ত্রখানি মেলিয়া ধরিয়া আবার যেন নূতন করিয়া শুভদৃষ্টি হইল। রাত্রির এই বিপুল অন্ধকার ভরিয়া গেল মণির অনিমেষ প্রেমের দৃষ্টিপাতে। এই ঘরের বধূ মণি, এই একটুখানি মণি, আজ বিশ্বরূপ ধরিল; জীবনমরণের সংগমতীর্থে ঐ নক্ষত্রবেদীর উপরে সে বসিল; নিস্তব্দ রাত্রি মঙ্গলঘটের মতাে পুণ্যধারায় ভরিয়া উঠিল। যতীন জোড়হাত করিয়া মনে মনে কহিল, ‘এত দিনের পর ঘােমটা খুলিল, এই ঘাের অন্ধকারের মধ্যে আবরণ ঘুচিল। অনেক কাঁদাইয়াছ— সুন্দর, হে সুন্দর, তুমি আর ফাঁকি দিতে পারিবে না।

8

“কষ্ট হচ্ছে মাসি, কিন্তু যত কষ্ট মনে করছ তার কিছুই নয়। আমার সঙ্গে আমার কষ্টের ক্রমশই যেন বিচ্ছেদ হয়ে আসছে। বােঝাই নৌকার মতাে এতদিন সে আমার জীবন-জাহাজের সঙ্গে বাঁধা ছিল; আজ যেন বাঁধন কাটা পড়েছে, সে আমার সব বােঝা নিয়ে দূরে ভেসে চলল। এখনও তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে যেন আর আমার ব’লে মনে হচ্ছে না—এ দুদিন মণিকে একবারও দেখি নি, মাসি।”

 “পিঠের কাছে আর-একটা বালিশ দেব কি যতীন।”

 “আমার মনে হচ্ছে মাসি, মণিও যেন চলে গেছে। আমার বাঁধন-ছেড়া দুঃখের নৌকাটির মতাে।”

 “বাবা, একটু বেদানার রস খাও, তােমার গলা শুকিয়ে আসছে।”

 “আমার উইলটা কাল লেখা হয়ে গেছে—সে কি আমি তােমাকে দেখিয়েছি—ঠিক মনে পড়ছে না।”

 “আমার দেখবার দরকার নেই, যতীন।”

 “মা যখন মারা যান আমার তাে কিছুই ছিল না। তােমার খেয়ে তােমার হাতে আমি মানুষ। তাই বলছিলুম—

 “সে আবার কী কথা। তােমার তাে কেবল এই একখানা বাড়ি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল। বাকি সবই তাে তােমার নিজের রােজগার।”

 “কিন্তু, এই বাড়িটা—”

 “কিসের বাড়ি আমার! কত দালান তুমি বাড়িয়েছ, আমার সে কোথায় আছে খুঁজেই পাওয়া যায় না।”