সিতাংশুমৌলিকে আমার সমকক্ষ বলে কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু, তবু ঐ মানুষটিকে আমি ঈর্ষা করেছি। কেন সে কথা যদি খুলে বলি তাে লােকে হাসবে। সকালবেলায় সিতাংশু একটা দুরন্ত ঘােড়ায় চড়ে বেড়াতে বােরােত—কী আশ্চর্য নৈপুণ্যের সঙ্গে রাশ বাগিয়ে এই জন্তুটাকে সে সংযত করত। এই দৃশ্যটি রােজই আমি দেখতুম আর ভাবতুম, ‘আহা, আমি যদি এইরকম অনায়াসে ঘােড়া হাঁকিয়ে যেতে পারতুম!’ পটুত্ব বলে যে জিনিসটি আমার একেবারেই নেই সেইটের ‘পরে আমার ভারি একটা গােপন লােভ ছিল। আমি গানের সুর ভালাে বুঝি নে, কিন্তু জানলা থেকে কতদিন গােপনে দেখেছি সিতাংশু এসরাজ বাজাচ্ছে—ঐ যন্ত্রটার ‘পরে তার একটি বাধাহীন সৌন্দর্যময় প্রভাব আমার কাছে আশ্চর্য মনোেহর বােধ হত। আমার মনে হত, যন্ত্রটা যেন প্রেয়সী-নারীর মতাে ওকে ভালােবাসে—সে আপনার সমস্ত সুর ওকে ইচ্ছা করে বিকিয়ে দিয়েছে। জিনিস-পত্র বাড়ি-ঘর জন্তু-মানুষ সকলের ‘পরেই সিতাংশুর এই সহজ প্রভাব ভারি একটি শ্রী বিস্তার করত। এই জিনিসটি অনির্বচনীয়, আমি একে নিতান্ত দুর্লভ না মনে করে থাকতে পারতুম না। আমি মনে করতুম, পৃথিবীতে কোনাে-কিছু প্রার্থনা করা এ লােকটির পক্ষে অনাবশ্যক, সবই আপনি এর কাছে এসে পড়বে, এ ইচ্ছা করে যেখানে গিয়ে বসবে সেইখানেই এর আসন পাতা।
তাই যখন একে একে আমার দ্বৈতগুলির অনেকেই পয়লা-নম্বরে টেনিস খেলতে, কন্সর্ট বাজাতে লাগল, তখন স্থানত্যাগের দ্বারা এই লুব্ধদের উদ্ধার করা ছাড়া আর-কোনাে উপায় খুঁজে পেলুম না। দালাল এসে খবর দিলে, মনের মতাে অন্য বাসা বরানগর-কাশীপুরের কাছাকাছি এক জায়গায় পাওয়া যাবে। আমি তাতে রাজি। সকাল তখন সাড়ে ন’টা। স্ত্রীকে প্রস্তুত হতে বলতে গেলুম। তাঁকে ভাঁড়ারঘরেও পেলুম না, রান্নাঘরেও না। দেখি, শােবার ঘরে জানলার গরাদের উপর মাথা রেখে চুপ করে বসে আছেন। আমাকে দেখেই উঠে পড়লেন। আমি বললুম, “পরশুই নতুন বাসায় যাওয়া যাবে।”
তিনি বললেন, “আর দিন পনেরাে সবুর করাে।”
জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন।”
অনিলা বললেন, “সরােজের পরীক্ষার ফল শীঘ্ন বেরােবে—তার জন্য মনটা উদ্বিগ্ন আছে, এ কয়দিন আর নড়াচড়া করতে ভালাে লাগছে না।”
অন্যান্য অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে এই একটি বিষয় আছে যা নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি কখনাে আলােচনা করি নে। সুতরাং আপাতত কিছুদিন বাড়িবদল মুলতবি রইল। ইতিমধ্যে খবর পেলুম, সিতাংশু শীঘ্রই দক্ষিণ-ভারতে বেড়াতে বেরােবে, সুতরাং দুই-নম্বরের উপর থেকে মস্ত ছায়াটা সরে যাবে।
অদৃষ্ট নাট্যের পঞ্চমাঙ্কের শেষ দিকটা হঠাৎ দৃষ্ট হয়ে ওঠে। কাল আমার স্ত্রী তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন; আজ ফিরে এসে তাঁর ঘরে দরজা বন্ধ করলেন। তিনি জানেন, আজ রাত্রে আমাদের দ্বৈতদলের পূর্ণিমার ভােজ। তাই নিয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করবার অভিপ্রায়ে দরজায় ঘা দিলুম। প্রথমে সাড়া পাওয়া গেল না। ডাক দিলুম, “অনু!” খানিক বাদে অনিলা এসে দরজা খুলে দিলে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “আজ রাত্রে রান্নার জোগাড় সব ঠিক আছে তাে?”