পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পয়লা নম্বর
৭৩৭

 সে কোনাে জবাব না দিয়ে মাথা হেলিয়ে জানালে যে, আছে।

 আমি বললুম, “তােমার হাতের তৈরি মাছের কচুরি আর বিলাতি আমড়ার চাট্‌নি ওদের খুব ভালাে লাগে, সেটা ভুলাে না।”

 এই বলে বাইরে এসেই দেখি কানাইলাল বসে আছে।

 আমি বললুম, “কানাই, আজ তােমরা একটু সকাল-সকাল এসাে।”

 কানাই আশ্চর্য হয়ে বললে, “সে কী কথা। আজ আমাদের সভা হবে নাকি।”

 আমি বললুম, “হবে বই-কি। সমস্ত তৈরি আছে—ম্যাক্সিম গর্কির নতুন গল্পের বই, বের্গ্‌স’র উপর রাসেলের সমালােচনা, মাছের কচুরি, এমনকি আমড়ার চাট্নি পর্যন্ত।”

 কানাই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক বাদে বললে, “অদ্বৈতবাবু, আমি বলি, আজ থাক্।”

 অবশেষে প্রশ্ন করে জানতে পারলুম, আমার শ্যালক সরােজ কাল বিকেলবেলায় আত্মহত্যা করে মরেছে। পরীক্ষায় সে পাস হতে পারে নি, তাই নিয়ে বিমাতার কাছ থেকে খুব গঞ্জনা পেয়েছিল—সইতে না পেরে গলায় চাদর বেঁধে মরেছে।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “তুমি কোথা থেকে শুনলে।”

 সে বললে, “পয়লা-নম্বর থেকে।”

 পয়লা-নম্বর থেকে! বিবরণটা এই—সন্ধ্যার দিকে অনিলার কাছে যখন খবর এল তখন সে গাড়ি ডাকার অপেক্ষা না করে অযােধ্যাকে সঙ্গে নিয়ে পথের মধ্যে থেকে গাড়ি ভাড়া করে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল। অযােধ্যার কাছ থেকে রাত্রে সিতাংশুমৌলি এই খবর পেয়েই তখনি সেখানে গিয়ে পুলিসকে ঠাণ্ডা করে নিজে শ্মশানে উপস্থিত থেকে মৃতদেহের সৎকার করিয়ে দেন।

 ব্যতিব্যস্ত হয়ে তখনি অন্তঃপুরে গেলুম। মনে করছিলুম, অনিলা বুঝি দরজা বন্ধ ক’রে আবার তার শােবার ঘরের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু, এবারে গিয়ে দেখি, ভাঁড়ারের সামনের বারান্দায় বসে সে আমড়ার চাট্‌নির আয়োজন করছে। যখন লক্ষ করে তার মুখ দেখলুম তখন বুঝলুম, এক রাত্রে তার জীবনটা উলট-পালট হয়ে গেছে। আমি অভিযােগ করে বললুম, “আমাকে কিছু বল নি কেন।”

 সে তার বড়ো বড়াে দুই চোখ তুলে একবার আমার মুখের দিকে তাকালে কোনাে কথা কইলে না। আমি লজ্জায় অত্যন্ত ছােটো হয়ে গেলুম। যদি অনিলা বলত ‘তােমাকে ব’লে লাভ কী’ তা হলে আমার জবাব দেবার কিছুই থাকত না। জীবনের এই-সব বিপ্লব— সংসারের সুখ দুঃখ—নিয়ে কী ক’রে যে ব্যবহার করতে হয়, আমি কি তার কিছুই জানি।

 আমি বললুম, “অনিল, এ-সব রাখাে, আজ আমাদের সভা হবে না।”

 অনিলা আমড়ার খােসা ছাড়াবার দিকে দৃষ্টি রেখে বললে, “কেন হবে না। খুব হবে। আমি এত করে সমস্ত আয়ােজন করেছি, সে আমি নষ্ট হতে দিতে পারব না।”

 আমি বললুম, “আজ আমাদের সভার কাজ হওয়া অসম্ভব।”

 সে বললে, “তােমাদের সভা না হয় না হবে, আজ আমার নিমন্ত্রণ।”

 আমি মনে একটু আরাম পেলুম। ভাবলুম, অনিলের শােকটা তত বেশি কিছু