পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পয়লা নম্বর
৭৩৯

যথোচিত হাল্কা করে দেখবার চেষ্টা করলুম। যেদিন আমার বিবাহ হয়েছিল সেই দিনকার কথাটা মনে করে শুষ্ক হাসি হাসলুম। মনে করলুম, মানুষ কত আকাঙ্ক্ষা, কত আয়ােজন, কত আবেগের অপব্যয় করে থাকে। কত দিন, কত রাত্রি, কত বৎসর নিশ্চিত মনে কেটে গেল; স্ত্রী বলে একটা সজীব পদার্থ নিশ্চয় আছে ব’লে চোখ বুজে ছিলুম; এমন সময় আজ হঠাৎ চোখ খুলে দেখি, বুদ্‌বুদ ফেটে গিয়েছে। গেছে যাক্ গে—কিন্তু, জগতে সবই তাে বুদ্‌বুদ নয়। যুগযুগান্তরের জন্মমত্যুকে অতিক্রম করে টিঁকে রয়েছে এমন-সব জিনিসকে আমি কি চিনতে শিখি নি।

 কিন্তু দেখলুম, হঠাৎ এই আঘাতে আমার মধ্যে নব্যকালের জ্ঞানীটা মূর্ছিত হয়ে পড়ল, আর কোন আদিকালের প্রাণীটা জেগে উঠে ক্ষুধায় কেঁদে বেড়াতে লাগল। বারান্দায় ছাতে পায়চারি করতে করতে, শূন্য বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে, শেষকালে, যেখানে জানালার কাছে কতদিন আমার স্ত্রীকে একলা চুপ করে বসে থাকতে দেখেছি, একদিন আমার সেই শােবার ঘরে গিয়ে পাগলের মতাে সমস্ত জিনিসপত্র ঘাঁটতে লাগলুম। অনিলের চুল বাঁধবার আয়নার দেরাজটা হঠাৎ টেনে খুলতেই রেশমের লাল ফিতেয় বাঁধা এক-তাড়া চিঠি বেরিয়ে পড়ল। চিঠিগুলি পয়লা নম্বর থেকে এসেছে। বুকটা জ্বলে উঠল। একবার মনে হল, সবগুলাে পুড়িয়ে ফেলি। কিন্তু, যেখানে বড়াে বেদনা সেইখানেই ভয়ংকর টান। এ চিঠিগুলাে সমস্ত না পড়ে আমার থাকবার জো নেই।

 এই চিঠিগুলি পঞ্চাশবার পড়েছি। প্রথম চিঠিখানা তিন-চার টুকরাে করে ছেঁড়া। মনে হল পাঠিকা পড়েই সেটি ছিঁড়ে ফেলে তার পরে আবার যত্ন করে একখানা কাগজের উপরে গঁদ দিয়ে জুড়ে রেখেছে। সে চিঠিখানা এই—

 ‘আমার এ চিঠি না পড়েই যদি তুমি ছিঁড়ে ফেলাে তবু আমার দুঃখ নেই। আমার যা বলবার কথা তা আমাকে বলতেই হবে।

 ’আমি তােমাকে দেখেছি। এতদিন এই পথিবীতে চোখ মেলে বেড়াচ্ছি, কিন্তু, দেখবার মতাে দেখা আমার জীবনে এই বত্রিশ বছর বয়সে প্রথম ঘটল। চোখের উপরে ঘুমের পর্দা টানা ছিল; তুমি সােনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছ—আজ আমি নবজাগরণের ভিতর দিয়ে তােমাকে দেখলুম, যে তুমি স্বয়ং তােমার সষ্টিকর্তার পরম বিস্ময়ের ধন সেই অনির্বচনীয় তােমাকে। আমার যা পাবার তা পেয়েছি, আর কিছু চাই নে, কেবল তােমার স্তব তােমাকে শােনাতে চাই। যদি আমি কবি হতুম তা হলে আমার এই স্তব চিঠিতে তােমাকে লেখবার দরকার হত না, ছন্দের ভিতর দিয়ে সমস্ত জগতের কণ্ঠে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে যেতুম। আমার এ চিঠির কোনাে উত্তর দেবে না জানি— কিন্তু, আমাকে ভুল বুঝাে না। আমি তােমার কোন ক্ষতি করতে পারি, এমন সন্দেহমাত্র মনে না রেখে আমার পূজা নীরবে গ্রহণ কোরাে। আমার এই শ্রদ্ধাকে যদি তুমি শ্রদ্ধা করতে পার তাতে তােমারও ভালাে হবে। আমি কে সে কথা লেখবার দরকার নেই, কিন্তু নিশ্চয়ই তা তােমার মনের কাছে গােপনে থাকবে না।’

 এমন পঁচিশখানি চিঠি। এর কোনাে চিঠির উত্তর যে অনিলের কাছ থেকে গিয়েছিল, এ চিঠিগুলির মধ্যে তার কোনাে নিদর্শন নেই। যদি যেত তা হলে তখনি বেসুর বেজে উঠত— কিম্বা তা হলে সােনার কাঠির জাদু একেবারে ভেঙে স্তবগান নীরব হত।