পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নামঞ্জুর গল্প
৭৫৯

খেতে শুতে তার সময় না-পাওয়াটা বিশেষ সমারোহ করেই ঘটে। এ পাড়ায় ও পাড়ায় খবর পৌঁছয়। কেউ যখন বলে এমন করলে শরীর টিঁকবে কী করে, সে একটুখানি হাসে— আশ্চর্য সেই হাসি। ভক্তরা বলে, “আপনি একটু বিশ্রাম করুন গে, একরকম করে কাজটা সেরে নেব”; সে তাতে ক্ষুণ্ণ হয়— ক্লান্তি থেকে বাঁচানোই কি বড়ো কথা। দুঃখগৌরব থেকে বঞ্চিত করা কি কম বিড়ম্বনা। তার ত্যাগস্বীকারের ফর্দের মধ্যে আমিও পড়ে গেছি। আমি যে তার এত বড়ো জেল-খাটা দাদা— উল্লাসকর-কানাই-বারীন-উপেন্দ্র প্রভৃতির সঙ্গে এক জ্যোতিষ্কমণ্ডলীতে যার স্থান, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পার হয়ে তার যে দাদা গীতার শেষ দিকের অধ্যায়ের মুখে অগ্রসর হয়েছে, তাকেও যথোচিত পরিমাণে দেখবার সে সময় পায় না। এত বড়ো স্যাক্রিফাইস! যেদিন কোনো কারণে তার দলের লোকের অভাব হয়েছে সেদিন আমিও তার উৎসাহের মৌতাত জোগাবার জন্য বলেছি, “অমিয়া, ব্যক্তিগত মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ তোর জন্যে নয়, তোর জন্যে বর্তমান যুগ।” আমার কথাটা সে গম্ভীরমুখে নীরবে মেনে নিয়েছে। জেলে যাওয়ার পর থেকে আমার হাসি অন্তঃশীলা বইছে— যারা আমাকে চেনে না তারা বাইরে থেকে আমাকে খুব গম্ভীর বলেই মনে করে।

 বিছানায় একলা পড়ে পড়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি: বিমুখা বান্ধবী যান্তি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেদিন কোথা থেকে একটা ন্যাঙলা কুকুর আমার বারান্দার কোণে আশ্রয় খুঁজছিল। গায়ের রোঁওয়া উঠে গেছে, জীর্ণ চামড়ার তলায় কঙ্কালের আব্রু নেই— আধমরা তার অবস্থা। অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেম। আজ ভাবছিলেম, এতটা বেশি ঝাঁজের সঙ্গে তাকে তাড়ালেম কেন। বেগানা কুকুর ব’লে নয়, ওর সর্বাঙ্গে মরণদশা দেখা দিয়েছে ব’লে। প্রাণের সংগীতসভায় ওর অস্তিত্বটা বেসুরো, ওর রুগ্‌ণতা বেয়াদবি। ওর সঙ্গে নিজের তুলনা মনে এল। চারি দিকের চলমান প্রাণের ধারার মধ্যে আমার অস্বাস্থ্য একটা স্থাবর পদার্থ, স্রোতের বাধা। সে দাবি করে, ‘শিয়রের কাছে চুপ করে বসে থাকো।’ প্রাণের দাবি, ‘দিকে বিদিকে চ’লে বেড়াও।’ রোগের বাঁধনে যে নিজে বদ্ধ, অরোগীকে সে বন্দী করতে চায়— এটা একটা অপরাধ। অতএব, জীবলোকের উপর সব দাবি একেবারে পরিত্যাগ করব মনে ক’রে গীতা খুলে বসলেম। প্রায় যখন স্থিতধী অবস্থায় এসে পৌঁচেছি, মনটা রোগ-অরোগের দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে গেছে, এমন সময় অনুভব করলেম কে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলে। গীতা থেকে চোখ নামিয়ে দেখি, পিসিমার পোষ্যমণ্ডলীভুক্ত একটি মেয়ে। এ পর্যন্ত দূরের থেকেই সাধারণভাবেই তাকে জানি; বিশেষভাবে তার পরিচয় জানি নে— তার নাম পর্যন্ত আমার অবিদিত। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে সে আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

 তখন মনে পড়ল, মাঝে মাঝে সে আমার দরজার বাইরের কোণে ছায়ার মতো এসে বারবার ফিরে ফিরে গেছে। বোধ করি সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারে নি। আমার অজ্ঞাতসারে আমার মাথা ধরার, গায়ে ব্যথার, ইতিবৃত্তান্ত সে আড়াল থেকে অনেকটা জেনে গিয়েছে। আজ সে লজ্জাভয় দূর ক’রে ঘরের মধ্যে এসে প্রণাম করে বসল। আমি যে একদিন একজন মেয়েকে অপমান থেকে বাঁচাবার জন্যে দুঃখস্বীকারের অর্থ নারীকে দিয়েছি, সে হয়তো বা দেশের সমস্ত মেয়ের হয়ে আমার পায়ের কাছে তারই প্রাপ্তিস্বীকার করতে এসেছে। জেল থেকে বেরিয়ে অনেক সভায় অনেক মালা পেয়েছি,