পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চিত্রকর
৭৭৫

নদীর ঢেউগুলো মকরের পাল, হাঁ ক’রে নৌকোটাকে গিলতে চলেছে এমনিতরো ভাব; আকাশের মেঘগুলোও যেন উপর থেকে চাদর উড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে— কিন্তু, মকরগুলো সর্বসাধারণের মকর নয়, আর মেঘগুলোকে ‘ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতাং সন্নিবেশঃ’ বললে অত্যুক্তি করা হবে। এ কথাও সত্যের অনুরোধে বলা উচিত যে, এইরকমের নৌকো যদি গড়া হয় তা হলে ইন্‌সুয়োরেন্স আপিস কিছুতেই তার দায়িত্ব নিতে রাজি হবে না। চলল রচনা, আকাশের চিত্রীও যা-খুশি তাই করছেন আর ঘরের মধ্যে ঐ মস্ত-চোখ-মেলা ছেলেটিও তথৈবচ।

 এদের খেয়াল ছিল না যে, দরজা খোলা। বড়োবাবু এলেন। গর্জন করে উঠলেন, “কী হচ্ছে রে!”

 ছেলেটার বুক কেঁপে উঠল, মুখ হল ফ্যাকাশে। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, পরীক্ষায় চুনিলালের ইতিহাসে তারিখ ভুল হচ্ছে তার কারণটা কোথায়। ইতিমধ্যে চুনিলাল ছবিটাকে তার জামার মধ্যে লুকোবার ব্যর্থ প্রয়াস করাতে অপরাধ আরও প্রকাশমান হয়ে উঠল। টেনে নিয়ে গোবিন্দ যা দেখলেন তাতে তিনি আরও অবাক— এটা ব্যাপারখানা কী। এর চেয়ে যে ইতিহাসের তারিখ ভুলও ভালো। ছবিটা কুটিকুটি ক’রে ছিঁড়ে ফেললেন। চুনিলাল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

 সত্যবতী একাদশীর দিন প্রায় ঠাকুরঘরেই কাটাতেন। সেইখান থেকে ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলেন। ছবির ছিন্ন খণ্ডগুলো মেঝের উপর লুটোচ্ছে আর মেঝের উপর লুটোচ্ছে চুনিলাল। গোবিন্দ তখন ইতিহাসের তারিখ-ভুলের আদি কারণগুলো সংগ্রহ করছিলেন অপসারণের অভিপ্রায়ে।

 সত্যবতী এতদিন কখনো গোবিন্দর কোনো ব্যবহারে কোনো কথা বলেন নি। এঁরই ’পরে তাঁর স্বামী নির্ভর স্থাপন করেছেন, এই স্মরণ করেই তিনি নিঃশব্দে সব সহ্য করেছেন। আজ তিনি অশ্রুতে আর্দ্র, ক্রোধে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, “কেন তুমি চুনির ছবি ছিঁড়ে ফেললে।”

 গোবিন্দ বললেন, “পড়াশুনো করবে না? আখেরে ওর হবে কী?”

 সত্যবতী বললেন, “আখেরে ও যদি পথের ভিক্ষুক হয় সেও ভালো। কিন্তু, কোনোদিন তোমার মতো যেন না হয়। ভগবান ওকে যে সম্পদ দিয়েছেন তারই গৌরব যেন তোমার পয়সার গর্বের চেয়ে বেশি হয়, এই ওর প্রতি আমার, মায়ের আশীর্বাদ।”

 গোবিন্দ বললেন, “আমার দায়িত্ব আমি ছাড়তে পারব না, এ চলবে না কিছুতেই। আমি কালই ওকে বোর্ডিং-স্কুলে পাঠিয়ে দেব— নইলে তুমি ওর সর্বনাশ করবে।”

 বড়োবাবু আপিসে গেলেন। ঘনবৃষ্টি নামল, রাস্তা জলে ভেসে যাচ্ছে।

 সত্যবতী চুনির হাত ধরে বললেন, “চল্, বাবা।”

 চুনি বললে, “কোথায় যাবে, মা।”

 “এখান থেকে বেরিয়ে যাই।”

 রঙ্গলালের দরজায় এক হাঁটু জল। সত্যবতী চুনিলালকে নিয়ে তার ঘরে ঢুকলেন; বললেন, “বাবা, তুমি নাও এর ভার। বাঁচাও একে পয়সার সাধনা থেকে।”

 কার্তিক ১৩৩৬