পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৭৮
গল্পগুচ্ছ

‘প্রভাতে মেঘডম্বরম্’, বেলা হলেই যাবে মিলিয়ে। ঐখানেই সুনেত্রার সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য। খিদে মিটতে না দিয়ে খিদে মেরে দেওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন পাত পড়বে তখন হৃদয়ের রসনায় নবীন ভালোবাসার স্বাদ যাবে মরে। মধ্যাহ্নে ভোরের সুর লাগাতে গেলে আর লাগে না। অভিভাবক বলেন, বিবেচনা করবার বয়েস হোক আগে, তার পরে, ইত্যাদি। হায় রে, বিবেচনা করবার বয়েস ভালোবাসার বয়েসের উল্টো পিঠে।

 কয়েকদিন আগেই এসেছিল ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’। ঘনবর্ষণের আড়ালে কলকাতার ইঁটকাঠের বাড়িগুলো এল মোলায়েম হয়ে, শহরের প্রখর মুখরতা অশ্রুগদ্‌গদ কণ্ঠস্বরের মতো হল বাষ্পাকুল। ওর মা জানত অরুণা আমার লাইব্রেরি ঘরে পরীক্ষার পড়ায় প্রবৃত্ত। একখানা বই আনতে গিয়ে দেখি, মেঘাচ্ছন্ন দিনান্তের সজল ছায়ায় জানলার সামনে সে চুপ করে বসে; তখনো চুল বাঁধে নি, পুবে হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে তার এলোচুলে।

 সুনেত্রাকে কিছু বললেম না। তখনি শৈলেনকে লিখে দিলেম চায়ের নিমন্ত্রণ- চিঠি। পাঠিয়ে দিলেম আমার মোটরগাড়ি ওদের বাড়িতে। শৈলেন এল, তার অকস্মাৎ আবির্ভাব সুনেত্রার পছন্দ নয়, সেটা বোঝা কঠিন ছিল না। আমি শৈলেনকে বললেম, “গণিতে আমার যেটুকু দখল তাতে হাল আমলের ফিজিক্সের তল পাইনে, তাই তোমাকে ডেকে পাঠানো; কোয়াণ্টম্ থিওরিটা যথাসাধ্য বুঝে নিতে এসে আমার সেকেলে বিদ্যেসাধ্যি অত্যন্ত বেশি অথর্ব হয়ে পড়েছে।”

 বলা বাহুল্য, বিদ্যাচর্চা বেশিদূর এগোয় নি। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস অরুণা তার বাবার চাতুরি স্পষ্টই ধরেছে আর মনে মনে বলেছে, এমন আদর্শ বাবা অন্য কোনো পরিবারে আজ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয় নি।

 কোয়াণ্টম্ থিওরির ঠিক শরতেই বাজল টেলিফোনের ঘণ্টা— ধড়্‌ফড়িয়ে উঠে বললেম, “জরুরি কাজের ডাক। তোমরা এক কাজ করো, ততক্ষণ পার্লার টেনিস খেলো, ছুটি পেলেই আবার আসব ফিরে।”

 টেলিফোনে আওয়াজ এল, “হ্যালো, এটা কি বারোশো অমুক নম্বর।”

 আমি বললেম, “না, এখানকার নম্বর সাতশো অমুক।”

 পরক্ষণেই নীচের ঘরে গিয়ে একখানা বাসি খবরের কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেম, অন্ধকার হয়ে এল, দিলেম বাতি জ্বেলে।

 সুনেত্রা এল ঘরে। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে। আমি হেসে বললেম, “মিটিয়রলজিস্‌ট্ তোমার মুখ দেখলে ঝড়ের সিগ্‌নাল দিত।”

 ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে সুনেত্রা বললে, “কেন তুমি শৈলেনকে অমন করে প্রশ্রয় দাও বারে বারে।”

 আমি বললেম, “প্রশ্রয় দেবার লোক অদৃশ্যে আছে ওর অন্তরাত্মায়।”

 “ওদের দেখাশোনাটা কিছুদিন বন্ধ রাখতে পারলে এই ছেলেমানুষিটা কেটে যেত আপনা হতেই।”

 “ছেলেমানুষির কসাইগিরি করতে যাবই বা কেন। দিন যাবে, বয়স বাড়বে, এমন ছেলেমানুষি আর তো ফিরে পাবে না কোনো কালে।”

 “তুমি গ্রহনক্ষত্র মান’ না, আমি মানি। ওরা মিলতে পারে না।”