পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গুপ্তধন
৫৫৩

জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি।”

 কোনাে উত্তর পাইলেন না। লােকটা অচেতন হইয়া গেছে।

 তখন চকমকি ঠুকিয়া ঠুকিয়া সন্ন্যাসী অনেক কষ্টে মশাল ধরাইলেন। ইতিমধ্যে সেই লােকটাও সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হইল, আর উঠিবার চেষ্টা করিয়া বেদনায় আর্তনাদ করিয়া উঠিল।

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “এ কী, মত্যুঞ্জয় যে! তােমার এ মতি হইল কেন।”

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “বাবা, মাপ করাে। ভগবান আমাকে শাস্তি দিয়াছেন। তােমাকে পাথর ছুঁড়িয়া মারিতে গিয়া সামলাইতে পারি নাই—পিছলে পাথরসুদ্ধ আমি পড়িয়া গেছি। পা’টা নিশ্চয় ভাঙিয়া গেছে।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “আমাকে মারিয়া তােমার কী লাভ হইত।”

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “লাভের কথা তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ! তুমি কিসের লােভে আমার পূজাঘর হইতে লিখনখানি চুরি করিয়া এই সুরঙ্গের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তুমি চোর, তুমি ভণ্ড! আমার পিতামহকে যে সন্ন্যাসী ঐ লিখনখানি দিয়াছিলেন তিনি বলিয়াছিলেন, আমাদেরই বংশের কেহ এই লিখনের সংকেত বুঝিতে পারিবে। এই গুপ্ত ঐশ্বর্য আমাদেরই বংশের প্রাপ্য। তাই আমি এ কয়দিন না-খাইয়া না-ঘুমাইয়া ছায়ার মতাে তােমার পশ্চাতে ফিরিয়াছি। আজ যখন তুমি বলিয়া উঠিলে ‘পাইয়াছি’ তখন আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমি তােমার পশ্চাতে আসিয়া ঐ গর্তটার ভিতরে লুকাইয়া বসিয়া ছিলাম। ওখান হইতে একটা পাথর খসাইয়া তােমাকে মারিতে গেলাম, কিন্তু শরীর দুর্বল, জায়গাটাও অত্যন্ত পিছল—তাই পড়িয়া গেছি—এখন তুমি আমাকে মারিয়া ফেলাে সেও ভালাে—আমি যক্ষ হইয়া এই ধন আগলাইব—কিন্তু তুমি ইহা লইতে পারিবে না—কোনােমতেই না। যদি লইতে চেষ্টা কর, আমি ব্রাহ্মণ, তােমাকে অভিশাপ দিয়া এই কূপের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিব। এ ধন তােমার ব্রহ্মরক্ত গােরক্ত-তুল্য হইবে—এ ধন তুমি কোনদিন সুখে ভােগ করিতে পারিবে না। আমাদের পিতা-পিতামহ এই ধনের উপরে সমস্ত মন রাখিয়া মরিয়াছেন—এই বনের ধ্যান করিতে করিতে আমরা দরিদ্র হইয়াছি—এই ধনের সন্ধানে আমি বাড়িতে অনাথা স্ত্রী ও শিশুসন্তান ফেলিয়া আহারনিদ্রা ছাড়িয়া লক্ষ্মীছাড়া পাগলের মতাে মাঠে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি—এ ধন তুমি আমার চোখের সম্মুখে কখনাে লইতে পারিবে না।”

সন্ন্যাসী কহিলেন, “মত্যুঞ্জয়, তবে শােনাে। সমস্ত কথা তােমাকে বলি।—তুমি জান, তােমার পিতামহের এক কনিষ্ঠ সহােদর ছিল, তার নাম ছিল শংকর।”

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “হাঁ, তিনি নিরুদ্দেশ হইয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “আমি সেই শংকর।”

 মত্যুঞ্জয় হতাশ হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। এতক্ষণ এই গুপ্ত ধনের উপর তাহার যে একমাত্র দাবি সে সাব্যস্ত করিয়া বসিয়াছিল, তাহারই বংশের আত্মীয় আসিয়া সে দাবি নষ্ট করিয়া দিল।