পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাস্টারমশায়
৫৬৩

করিলেন—কিন্তু তিনি নাকি বরাবর ছাত্রদিগকে কড়া শাসনে চালাইয়া আজ পর্যন্ত মাস্টারি মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া আসিয়াছেন, সেইজন্য তাঁহার ভাষার মিস্টতা ও আচারের শিস্টতায় কেবলই বেসুর লাগিল—সেই শুস্ক সাধনায় ছেলে ভুলিল না।
 ননীবালা অধরলালকে কহিলেন, “ও তোমার কেমন মাস্টার। ওকে দেখিলেই যে ছেলে অস্থির হইয়া উঠে। ওকে ছাড়াইয়া দাও।”
 বুড়া মাস্টার বিদায় হইল। সেকালে মেয়ে যেমন স্বয়ম্বরা হইত তেমনি ননী- বালার ছেলে স্বয়ম্মাস্টার হইতে বসিল-সে যাহাকে না বরিয়া লইবে তাহার সকল পাস ও সকল সার্টিফিকেট বৃথা।
  এমনি সময়টিতে গায়ে একখানি ময়লা চাদর ও পায়ে ছেঁড়া ক্যাম্বিসের জুতা পরিয়া মাস্টারির উমেদারিতে হরলাল আসিয়া জুুটিল। তাহার বিধবা মা পরের বাড়িতে রাঁধিয়া ও ধান ভানিয়া তাহাকে মফস্বলের এনট্রেন্স স্কুলে কোনোমতে এনট্রেন্স পাস করাইয়াছে। এখন হরলাল কলিকাতায় কলেজে পড়িবে বলিয়া প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা করিয়া বাহির হইয়াছে। অনাহারে তাহার মুখের নিম্ন অংশ শুকাইয়া ভারতবর্ষের ‘কন্যাকুমারী'র মতো সরু হইয়া আসিয়াছে, কেবল মস্ত কপালটা হিমালয়ের মতো প্রশস্ত হইয়া অত্যন্ত চোখে পড়িতেছে। মরুভূমির বালু হইতে সূর্যের আলো যেমন ঠিকরিয়া পড়ে তেমনি তাহার দুই চক্ষু হইতে দৈন্যের একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি বাহির হইতেছে।
 দরোয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী চাও। কাহাকে চাও।” হরলাল ভয়ে ভয়ে বলিল, “বাড়ির বাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চাই।” দরোয়ান কহিল, “দেখা হইবে না।” তাহার উত্তরে হরলাল কী বলিবে ভাবিয়া না পাইয়া ইতস্তত করিতেছিল, এমন সময় সাত বছরের ছেলে বেণুগোপাল বাগানে খেলা সারিয়া দেউড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। দরোয়ান হরলালকে দ্বিধা করিতে দেখিয়া আবার কহিল, “বাবু, চলা যাও।”
  বেণুর হঠাৎ জিদ্ চড়িল—সে কহিল, “নেহি যায় গা।” বলিয়া সে হরলালের হাত ধরিয়া তাহাকে দোতলার বারান্দায় তাহার বাপের কাছে লইয়া হাজির করিল।
 বাবু তখন দিবানিদ্রা সারিয়া জড়ালসভাবে বারান্দায় বেতের কেদারায় চুপচাপ বসিয়া পা দোলাইতেছিলেন ও বৃদ্ধ রতিকান্ত একটা কাঠের চৌকিতে আসন হইয়া বসিয়া ধীরে ধীরে তামাক টানিতেছিল। সেদিন এই সময়ে এই অবস্থায় দৈবক্রমে হরলালের মাস্টারি বাহাল হইয়া গেল।
 রতিকান্ত জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার পড়া কিপর্যন্ত।”
 হরলাল একটুখানি মুখ নিচু করিয়া কহিল, “এনট্রেন্স পাস করিয়াছি।”
 রতিকান্ত ভ্রু তুলিয়া কহিল, “শুধু এনট্রেন্স পাস?” আমি বলি কলেজে পড়িয়াছেন। আপনার বয়সও তো নেহাত কম দেখি না।”
 হরলাল চুপ করিয়া রহিল। আশ্রিত ও আশ্রয়প্রত্যাশীদিগকে সকল রকমে পীড়ন করাই রতিকান্তের প্রধান আনন্দ ছিল।
 রতিকান্ত আদর করিয়া বেণুকে কোলের কাছে টানিয়া লইবার চেস্টা করিয়া কহিল, “কত এম-এ বি-এ আসিল ও গেল, কাহাকেও পছন্দ হইল না—আর শেষকালে কি সোনাবাবু এনট্রেন্স-পাস-করা মাস্টারের কাছে পড়িবেন!”