ভবানীচরণ কহিলেন, “দেখ নাই! ও চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কী যেন ভাবে।”
রাসমণি কহিলেন, “ও একদণ্ড চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে আমি তো বাঁচতাম। ওর আবার ভাবনা! কোথায় কী দুষ্টামি করিতে হইবে, ও সেই কথাই ভাবে।”
দুর্গপ্রাচীরের এ দিকটাতেও কোনো দুর্বলতা দেখা গেল না— পাথরের উপরে গোলার দাগও বসিল না। নিশ্বাস ফেলিয়া মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে ভবানীচরণ বাহিরে চলিয়া আসিলেন। একলা ঘরের দাওয়ায় বসিয়া খুব কষিয়া তামাক খাইতে লাগিলেন।
পঞ্চমীর দিনে তাঁহার পাতে দই পায়স অমনি পড়িয়া রহিল। সন্ধ্যাবেলায় শুধু একটা সন্দেশ খাইয়াই জল খাইলেন, লুচি ছু‘ইতে পারিলেন না। বলিলেন, ক্ষুধা একেবারেই নাই।
এবার দুর্গপ্রাচীরে মস্ত একটা ছিদ্র দেখা দিল। যষ্ঠীর দিনে রাসমণি স্বয়ং কালীপদকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া তাহার আদরের ডাক-নাম ধরিয়া বলিলেন, “ভে‘টু, তোমার এত বয়স হইয়াছে, তবু তোমার অন্যায় আবদার ঘুচিল না! ছি ছি! যেটা পাইবার উপায় নাই সেটাকে লোভ করিলে অর্ধেক চুরি করা হয়, তা জান!”
কালীপদ নাকী সুরে কহিল, “আমি কী জানি। বাবা যে বলিয়াছেন, ওটা আমাকে দেবেন।”
তখন বাবার বলার অর্থ কী রাসমণি তাহা কালীপদকে বুঝাইতে বসিলেন। পিতার এই বলার মধ্যে যে কত স্নেহ, কত বেদনা, অথচ এই জিনিসটা দিতে হইলে তাঁহাদের দরিদ্রঘরের কত ক্ষতি, কত দুঃখ, তাহা অনেক করিয়া বলিলেন। রাসমণি এমন করিয়া কোনোদিন কালীপদকে কিছু বুঝান নাই— তিনি যাহা করিতেন, খুব সংক্ষেপে এবং জোরের সঙ্গেই করিতেন— কোনো আদেশকে নরম করিয়া তুলিবার আবশ্যকই তাঁর ছিল না। সেইজন্য কালীপদকে তিনি যে আজ এমনি মিনতি করিয়া, এত বিস্তারিত করিয়া কথা বলিতেছেন তাহাতে সে আশ্চর্য হইয়া গেল, এবং মাতার মনের এক জায়গায় যে কতটা দরদ আছে বালক হইয়াও এক রকম করিয়া সে তাহা বুঝিতে পারিল। কিন্তু, মেমের দিক হইতে মন এক মুহূর্তে ফিরাইয়া আনা কত কঠিন, তাহা বয়স্ক পাঠকদের বুঝিতে কষ্ট হইবে না। তাই কালীপদ মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া একটা কাঠি লইয়া মাটিতে আঁচড় কাটিতে লাগিল।
তখন রাসমণি আবার কঠিন হইয়া উঠিলেন; কঠোর স্বরে কহিলেন, “তুমি রাগই কর আর কান্নাকাটিই কর, যাহা পাইবার নয় তাহা কোনোমতেই পাইবে না।”
এই বলিয়া আর বৃথা সময় নষ্ট না করিয়া দ্রুতপদে গৃহকর্মে চলিয়া গেলেন।
কালীপদ বাহিরে গেল। তখন ভবানীচরণ একলা বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন। দূর হইতে কালীপদকে দেখিয়াই তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া যেন একটা বিশেষ কাজ আছে এমনি ভাবে কোথায় চলিলেন। কালীপদ ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “বাবা, আমার সেই মেম—”
আজ আর ভবানীচরণের মুখে হাসি বাহির হইল না; কালীপদর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন, “রোস্ বাবা, আমার একটা কাজ আছে— সেরে আসি, তার পরে সব কথা হবে।”— বলিয়া তিনি বাড়ির বাহির হইয়া পড়িলেন। কালীপদর মনে হইল, তিনি যেন তাড়াতাড়ি চোখ হইতে জল মুছিয়া ফেলিলেন।
পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৮৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রাসমণির ছেলে
৫৯৩