পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্মফল
৫৯৯

দিতে চাই, ঘড়ি ঘড়ির-চেন জোগাতে চাই নে।

 শশধর। সে তো ভালো কথা, কিন্তু তোমার ইচ্ছামাত্রেই তো সংসারের সমস্ত বাধা তখনি ধুলিসাৎ হবে না। সকলেরই যদি তোমার মতো সদ্‌বুদ্ধি থাকত তা হলে তো কথাই ছিল না; তা যখন নেই তখন সাধুসংকল্পকেও গায়ের জোরে চালানো যায় না, ধৈর্য চাই। স্ত্রীলোকের ইচ্ছার একেবারে উলটামুখে চলবার চেষ্টা করলে অনেক বিপদে পড়বে—তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে একটু ঘুরে গেলে সুবিধামতো ফল পাওয়া যায়। বাতাস যখন উলটা বয় জাহাজের পাল তখন আড় করে রাখতে হয়, নইলে চলা অসম্ভব।

 মন্মথ। তাই বুঝি তুমি গৃহিণীর সকল কথাতেই সায় দিয়ে যাও। ভীরু!

 শশধর। তোমার মতো অসম সাহস আমার নেই। যাঁর ঘরকন্নার অধীনে চবিশ ঘণ্টা বাস করতে হয় তাঁকে ভয় না করব তো কাকে করব। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কী। আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট। তার চেয়ে তর্কের বেলায় গহিণীর মতকে সম্পূর্ণ অকাট্য বলে স্বীকার করে কাজের বেলায় নিজের মত চালানোই সৎপরামর্শ—গোঁয়ার্‌তুমি করতে গেলেই মুশকিল বাধে।

 মন্মথ। জীবন যদি সুদীর্ঘ হত তবে ধীরে-সুস্থে তোমার মতে চলা যেত, পরমায়ু যে অল্প।

 শশধর। সেইজন্যই তো ভাই, বিবেচনা করে চলতে হয়। সামনে একটা পাথর পড়লে যে লোক ঘরে না গিয়ে সেটা ডিঙিয়ে পথ সংক্ষেপ করতে চায়, বিলম্ব তারই অদৃষ্টে আছে। কিন্তু তোমাকে এ-সকল বলা বৃথা—প্রতিদিনই তো ঠেকছ তবু যখন শিক্ষা পাচ্ছ না, তখন আমার উপদেশে ফল নেই। তুমি এমনি ভাবে চলতে চাও যেন তোমার স্ত্রী ব’লে একটা শক্তির অস্তিত্ব নেই—অথচ তিনি যে আছেন সম্বন্ধে তোমার লেশমাত্র সন্দেহ থাকবার কোনো কারণ দেখি নে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দাম্পত্য কলহে চৈব বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া—শাস্ত্রে এইরূপ লেখে। কিন্তু দম্পতি বিশেষে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাহা অস্বীকার করেন না।

 মন্মথবাবুর সহিত তাঁহার স্ত্রীর মধ্যে মধ্যে যে বাদপ্রতিবাদ ঘটিয়া থাকে তাহা নিশ্চয়ই কলহ, তবু তাহার আরম্ভ বহু নহে, তাহার ক্রিয়াও লঘু নহে—ঠিক অজাযুদ্ধের সঙ্গে তাহার তুলনা করা চলে না। কয়েকটি দৃষ্টান্তদ্বারা এ কথার প্রমাণ হইবে।

 মন্মথবাবু কহিলেন, “তোমার ছেলেটিকে যে বিলিতি পোশাক পরাতে আরম্ভ করেছ, সে আমার পছন্দ নয়।”

 বিধু কহিলেন, “পছন্দ বুঝি একা তোমারই আছে। আজকাল তো সকলেই ছেলেদের ইংরেজি কাপড় ধরিয়েছে।”

 মন্মথ হাসিয়া কহিলেন, “সকলের মতেই যদি চলবে তবে সকলকে ছেড়ে একমাত্র আমাকেই বিবাহ করলে কেন।”

বিধু। তুমি যদি কেবল নিজের মতেই চলবে তবে একা না থেকে আমাকেই বা