অথচ ভবানীচরণের পক্ষে পৈতৃক বিষয়ের ন্যায্য অংশ হইতে বঞ্চিত হওয়ার মধ্যে যে একটা নিষ্ঠুর অন্যায় আছে, সে কথাও সে কোনোমতে অস্বীকার করিতে পারিল না। এখন হইতে এই প্রসঙ্গে কোনোপ্রকার তর্ক করা সে বন্ধ করিয়া দিল—একেবারে সে চুপ করিয়া থাকিত—এবং যদি কোনো সুযোগ পাইত তবে উঠিয়া চলিয়া যাইত।
এখনো বিকালে একটু অল্প জ্বর আসিয়া কালীপদর মাথা ধরিত কিন্তু সেটাকে সে রোগ বলিয়া গণ্যই করিত না। পড়ার জন্য তাহার মন উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। একবার তাহার স্কলারশিপ ফসকাইয়া গিয়াছে, আর তো সেরূপ হইলে চলিবে না। শৈলেনকে লুকাইয়া আবার সে পড়িতে আরম্ভ করিল; এ সম্বন্ধে ডাক্তারের কঠোর নিষেধ আছে জানিয়াও সে তাহা অগ্রাহ্য করিল।
ভবানীচরণকে কালীপদ কহিল, “বাবা, তুমি বাড়ি ফিরিয়া যাও—সেখানে মা একলা আছেন। আমি তো বেশ সারিয়া উঠিয়াছি।”
শৈলেনও বলিল, “এখন আপনি গেলে কোনো ক্ষতি নাই। আর তো ভাবনার কারণ কিছু দেখি না। এখন যেটুকু আছে সে দুদিনেই সারিয়া যাইবে। আর, আমরা তো আছি।”
ভবানীচরণ কহিলেন, “সে আমি বেশ জানি; কালীপদর জন্য ভাবনা করিবার কিছুই নাই। আমার কলিকাতায় আসিবার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, তবু মন মানে কই, ভাই। বিশেষত তোমার ঠাকরুনদিদি যখন যেটি ধরেন সে তো আর ছাড়াইবার জো নাই।”
শৈলেন হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরদা, তুমিই তো আদর দিয়া ঠাকরুনদিদিকে একেবারে মাটি করিয়াছ।”
ভবানীচরণ হাসিয়া কহিলেন, “আচ্ছা ভাই, আচ্ছা, ঘরে যখন নাতবউ আসিবে তখন তোমার শাসনপ্রণালীটা কিরকম কঠোর আকার ধারণ করে দেখা যাইবে।”
ভবানীচরণ একান্তভাবে রাসমণির সেবায় পালিত জীব। কলিকাতার নানাপ্রকার আরাম-আয়োজনও রাসমণির আদরযত্নের অভাব কিছুতেই পূরণ করিতে পারিতেছিল না। এই কারণে ঘরে যাইবার জন্য তাঁহাকে বড়ো বেশি অনুরোধ করিতে হইল না।
সকালবেলায় জিনিসপত্র বাঁধিয়া প্রস্তুত হইয়াছেন, এমন সময় কালীপদর ঘরে গিয়া দেখিলেন তাহার মুখচোখ অত্যন্ত লাল হইয়া উঠিয়াছে—তাহার গা যেন আগুনের মতো গরম। কাল অর্ধেক রাত্রি সে লজিক মুখস্ত করিয়াছে, বাকি রাত্রি এক নিমেষের জন্যও ঘুমাইতে পারে নাই।
কালীপদর দুর্বলতা তো সারিয়া উঠে নাই, তাহার উপরে আবার রোগের প্রবল আক্রমণ দেখিয়া ডাক্তার বিশেষ চিন্তিত হইলেন। শৈলেনকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গিয়া বলিলেন, “এবার তো গতিক ভালো বোধ করিতেছি না।”
শৈলেন ভবানীচরণকে কহিল, “দেখো ঠাকুরদা, তোমারও কষ্ট হইতেছে, রোগীরও বোধ হয় ঠিক তেমন সেবা হইতেছে না, তাই আমি বলি, আর দেরি না করিয়া ঠাকরুন-দিদিকে আনানো যাক।”
শৈলেন যতই ঢাকিয়া বলুক, একটা প্রকাণ্ড ভয় আসিয়া ভবানীচরণের মনকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। তাঁহার হাত-পা থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তিনি
পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৯৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রাসমণির ছেলে
৬০৯