সন্দেহের কারণ ঘটেছে।”
বিনোদ অত্যন্ত অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “কিছুমাত্র না।”
অম্বিকাচরণ নয়নতারার ঘটনা উল্লেখমাত্র না করিয়া আপিসে চলিয়া আসিলেন, বাড়িতে ইন্দ্রাণীকেও কিছু বলিলেন না। এইভাবে কিছু দিন গেল।
এমন সময় অম্বিকাচরণ ইন্ফ্লুয়েঞ্জায় পড়িলেন। শক্ত ব্যামো নহে কিন্তু দুর্বলতাবশত অনেক দিন আপিস কামাই করিতে হইল।
সেই সময় সদর খাজনা দেয় এবং অন্যান্য কাজের বড়ো ভিড়। সেইজন্য একদিন সকালে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া অম্বিকাচরণ হঠাৎ আপিসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেদিন কেহই তাঁহাকে প্রত্যাশা করে নাই, এবং সকলেই বলিতে লাগিল, “আপনি বাড়ি যান, এত কাহিল শরীরে কাজ করিবেন না।”
অম্বিকাচরণ নিজের দুর্বলতার প্রসঙ্গ উড়াইয়া দিয়া, ডেস্কে গিয়া বসিলেন। আমলারা সকলেই কিছু যেন অস্থির হইয়া উঠিল এবং হঠাৎ অত্যন্ত অতিরিক্ত মনোযোগের সহিত নিজ নিজ কাজে প্রবৃত্ত হইল।
অম্বিকাচরণ ডেস্ক্ খুলিয়া দেখেন তাহার মধ্যে তাঁহার একখানি কাগজও নাই। সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কী”; সকলেই যেন আকাশ হইতে পড়িল, চোরে লইয়াছে কি ভূতে লইয়াছে কেহ ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না।
বামাচরণ কহিল, “আরে মশায়, আপনারা ন্যাকামি রেখে দিন। সকলেই জানেন, ওর কাগজপত্র বাবু নিজে তলব ক'রে নিয়ে গেছেন।”
অম্বিকা রুদ্ধ রোষে শ্বেতবর্ণ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন।”
বামাচরণ কাগজ লিখিতে লিখিতে বলিল, “সে আমরা কেমন করে বলব।”
বিনোদ অম্বিকাচরণের অনুপস্থিতিসুযোগে বামাচরণের মন্ত্রণাক্রমে নূতন চাবি তৈয়ার করাইয়া ম্যানেজারের প্রাইভেট ডেস্ক্ খুলিয়া তাঁহার সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করিতে লইয়া গিয়াছেন। চতুর বামাচরণ সে কথা গোপন করিল না—অম্বিকা অপমানিত হইয়া কাজে ইস্তফা দেন ইহা তাহার অনভিপ্রেত ছিল না।
অম্বিকাচরণ ডেস্কে চাবি লাগাইয়া কম্পিতদেহে বিনোদের সন্ধানে গেলেন-বিনোদ বলিয়া পাঠাইল তাহার মাথা ধরিয়াছে। সেখান হইতে বাড়ি গিয়া হঠাৎ দুর্বল- দেহে বিছানায় শুইয়া পড়িলেন। ইন্দ্রাণী তাড়াতাড়ি ছুটিয়া আসিয়া তাঁহাকে তাহার সমস্ত হৃদয় দিয়া যেন আবৃত করিয়া ধরিল। ক্রমে ইন্দ্রাণী সকল কথা শুনিল।
স্থিরসৌদামিনী আজ স্থির রহিল না—তাহার বক্ষ ফুলিতে লাগিল, বিস্ফারিত মেঘকৃষ্ণ চক্ষুপ্রান্ত হইতে উন্মুক্ত বজ্রশিখা সুতীব্র উগ্র জ্বালা বিক্ষেপ করিতে লাগিল। এমন স্বামীর এমন অপমান! এত বিশ্বাসের এই পুরস্কার।
ইন্দ্রাণীর এই অত্যুগ্র নিঃশব্দ রোষদাহ দেখিয়া অম্বিকার রাগ থামিয়া গেল-তিনি যেন দেবতার শাসন হইতে পাপীকে রক্ষা করিবার জন্য ইন্দ্রাণীর হাত ধরিয়া বলিলেন, “বিনোদ ছেলেমানুষ, দুর্বলস্বভাব, পাঁচ জনের কথা শুনে তার মন বিগড়ে গেছে।”
তখন ইন্দ্রাণী দুই হস্তে তাহার স্বামীর গলদেশ বেষ্টন করিয়া তাহাকে বক্ষের কাছে টানিয়া লইয়া আবেগের সহিত চাপিয়া ধরিল এবং হঠাৎ তাহার দুই চক্ষুর রোষদীপ্তি ম্লান করিয়া দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া অশ্রুজল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। পৃথিবীর সমস্ত অন্যায় হইতে, সমস্ত অপমান হইতে দুই বাহুপাশে টানিয়া লইয়া