মেঘ ও রৌদ্র
প্রথম পরিচ্ছেদ
পূর্বদিন বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আজ ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতঃকালে স্নান রৌদ্র ও খণ্ড মেঘে মিলিয়া পরিপকায় আউশ ধানের ক্ষেত্রের উপর পর্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল; সবিস্তৃত শ্যাম চিত্রপট একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জল পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিতেছিল আবার পরক্ষণেই ছায়াপ্রলেপে গাঢ় স্নিগ্ধতায় অঙ্কিত হইতেছিল।
যখন সমস্ত আকাশরঙ্গভূমিতে মেঘ এবং রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা, আপন আপন অংশ অভিনয় করিতেছিল তখন নিম্নে সংসাররঙ্গভূমিতে কত ধানে কত অভিনয় চলিতেছিল তাহার আর সংখ্যা নাই।
আমরা যেখানে একটি ক্ষুদ্র জীবননাট্যের পট উত্তোলন করিলাম সেখানে গ্রামে পথের ধারে একটি বাড়ি দেখা যাইতেছে। বাহিরের একটিমাত্র ঘর পাকা, এবং সেই ঘরের দুই পর্বে দিয়া জীর্ণ প্রায় ইষ্টকের প্রাচীর গুটিকতক মাটির ঘর বেষ্টন করিয়া আছে। পথ হইতে গরাদের জানলা দিয়া দেখা যাইতেছে, একটি যুবাপর খালি গায়ে তক্তপোষে বসিয়া বামহন্তে ক্ষণে ক্ষর্ণে তালপাতার পাখা লইয়া গ্রীষ্ম এবং মশক দর কবাির চেষ্টা করিতেছেন এবং দক্ষিণহতে বই লইয়া পাঠে নিবিষ্ট আছেন।
বাহিরে গ্রামের পথে একটি ডুরে-কাপড়-পরা বালিকা আঁচলে গুটিকতক কালো জাম লইয়া একে একে নিঃশেষ করিতে করিতে উক্ত গরাদে-দেওয়া জানলার সম্মুখে দিয়া বারম্বার যাতায়াত করিতেছিল। মুখের ভাবে পষ্টই বোঝা যাইতেছিল, ভিতরে যে মানুষটি তক্তপোষে বসিয়া বই পড়িতেছে তাহার সহিত বালিকার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে এবং কোনোমতে সে তাহার মনোযোগ আকর্ষণপূর্বক তাহাকে নীরবে অবজ্ঞাভরে জানাইয়া যাইতে চাহে যে সম্প্রতি কালোজাম খাইতে আমি অত্যন্ত ব্যস্ত আছি, তোমাকে আমি গ্রাহ্যমাত্র করি না॥
দুর্ভাগ্যক্রমে, ঘরের ভিতরকার অধ্যয়নশীল পুরষটি চক্ষে কম দেখেন, দর হইতে বালিকার নীরব উপেক্ষা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। বালিকাও তাহা জানিত সুতরাং অনেক ক্ষণ নিস্ফল আনাগোনার পর নীরব উপেক্ষার পরিবর্তে কালোজামের আঁটি ব্যবহার করিতে হইল। অন্ধের নিকটে অভিমানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা এতই দুরুহ।
যখন ক্ষণে ক্ষণে দুই-চারিটা কঠিন আঁটি যেন দৈবক্রমে বিক্ষিপ্ত হইয়া কাঠের দরজার উপর ঠক, করিয়া শব্দ করিয়া উঠিল তখন পাঠরত পুরুষটি মাথা তুলিয়া চাহিয়া দেখিল। মায়াবিনী বালিকা তাহা জানিতে পারিয়া দ্বিগুণ নিবিষ্টভাবে অঞ্চল হইতে দংশনযোগ্য সুপক্ক কালোজাম নির্বাচন করিতে প্রবৃত্ত হইল। পুষটি কুঞ্চিত করিয়া বিশেষ চেষ্টা-সহকারে নিরীক্ষণপর্বক বালিকাকে চিনিতে পারিল এবং বই রাখিয়া জানলার কাছে উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাস্যমুখে ডাকিল, “গিরিবালা!”
গিরিবালা অবিচলিত ভাবে নিজের অঞ্চলের মধ্যে জাম-পরীক্ষাকার্যে সম্পূর্ণ অভিনিবিষ্ট থাকিয়া মদগমনে আপন-মনে এক-এক পা করিয়া চলিতে লাগিল।