পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৭৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৩৮৬
গল্পগুচ্ছ

দিতে লাগিলেন। শালীদের সুকোমল বিম্বৌষ্ঠের ভিতর হইতে তীক্ষ্ণপ্রখর হাসি যখন টুক্‌টুকে মখমলের খাপের ভিতরকার ঝক্‌ঝকে ছোরার মতো দেখা দিতে লাগিল, তখন স্থানকালপাত্র সম্বন্ধে হতভাগ্যের চৈতন্য জন্মিল। বুঝিল, ‘বড়ো ভুল করিয়াছি।’

 শ্যালীবর্গের মধ্যে জ্যেষ্ঠা এবং রূপে গুণে শ্রেষ্ঠা লাবণ্যলেখা একদা শুভদিন দেখিয়া নবেন্দুর শয়নকক্ষের কুলুঙ্গির মধ্যে দুই জোড়া বিলাতি বুট সিন্দুরে মণ্ডিত করিয়া স্থাপন করিল; এবং তাহার সম্মুখে ফুলচন্দন ও দুই জ্বলন্ত বাতি রাখিয়া ধূপধুনা জালাইয়া দিল। নবেন্দু ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র দুই শ্যালী তাহার দুই কান ধরিয়া কহিল, “তোমার ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করো, তাহার কল্যাণে তোমার পদবৃদ্ধি হউক।”

 তৃতীয়া শ্যালী কিরণলেখা বহুদিন পরিশ্রম করিয়া একখানি চাদরে জোন্স্ স্মিথ ব্রাউন টম্‌সন প্রভৃতি একশত প্রচলিত ইংরাজি নাম লাল সুতা দিয়া সেলাই করিয়া একদিন মহাসমারোহে নবেন্দুকে নামাবলি উপহার দিল।

 চতুর্থ শ্যালী শশাঙ্কলেখা যদিও বয়ঃক্রম হিসাবে গণ্যব্যক্তির মধ্যে নহে, বলিল, “ভাই, আমি একটি জপমালা তৈরি করিয়া দিব। সাহেবের নাম জপ করিবে।”

 তাহার বড়ো বোনরা তাহাকে শাসন করিয়া বলিল, “যাঃ, তোর আর জ্যাঠামি করিতে হইবে না।”

 নবেন্দুর মনে মনে রাগও হয়, লজ্জাও হয়, কিন্তু শ্যালীদের ছাড়িতেও পারে না; বিশেষত বড়োশ্যালীটি বড়ো সুন্দরী। তাহার মধুও যেমন কাঁটাও তেমনি; তাহার নেশা এবং তাহার জ্বালা দুটোই মনের মধ্যে একেবারে লাগিয়া থাকে। ক্ষতপক্ষ পতঙ্গ রাগিয়া ভোঁ ভোঁ করিতে থাকে অথচ অন্ধ অবোধের মতো চারি দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে।

 অবশেষে শ্যালীসংসর্গের প্রবল মোহে পড়িয়া সাহেবের সোহাগলালসা নবেন্দু সম্পূর্ণ অস্বীকার করিতে লাগিল। বড়োসাহেবকে যেদিন সেলাম নিবেদন করিতে যাইত শ্যালীদিগকে বলিত, “সুরেন্দ্র বাঁড়ুজ্যের বক্তৃতা শুনিতে যাইতেছি।” দার্জিলিং হইতে প্রত্যাসন্ন মেজোসাহেবকে স্টেশনে সম্মান জ্ঞাপন করিতে যাইবার সময় শ্যালীদিগকে বলিয়া যাইত, “মেজোমামার সহিত দেখা করিতে চলিলাম।”

 সাহেব এবং শ্যালী এই দুই নৌকায় পা দিয়া হতভাগা বিষম সঙ্কটে পড়িল। শ্যালীরা মনে মনে কহিল, ‘তোমার অন্য নৌকাটাকে ফুটা না করিয়া ছাড়িব না।’

 মহারানীর আগাম জন্মদিনে নবেন্দু খেতাব-স্বর্গলোকের প্রথম সোপানে রায়-বাহাদুর-পদবীতে পদার্পণ করবেন এইরূপ গুজব শুনা গেল, কিন্তু সেই সম্ভাবিত সম্মানলাভের আনন্দ-উচ্ছসিত সংবাদ ভীরু বেচারা শ্যালীদিগের নিকট ব্যক্ত করিতে পারিল না; কেবল একদিন শরৎশুক্লপক্ষের সায়াহ্ণে সর্বনেশে চাঁদের আলোকে পরিপূর্ণ চিত্তাবেগে স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করিয়া ফেলিল। পরদিন দিবালোকে স্ত্রী পাল্কি করিয়া তাহার বড়োদিদির বাড়ি গিয়া অশ্রুগদ্‌গদ কণ্ঠে আক্ষেপ করতে লাগিল। লাবণ্য কহিল, “তা বেশ তো, রায়বাহাদুর হইয়া তোর স্বামীর তো লেজ বাহির হইবে না, তোর এত লজ্জাটা কিসের।”