পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৪৩০
গল্পগুচ্ছ

দুর্বুদ্ধি

ভিটা ছাড়িতে হইল। কেমন করিয়া তাহা খােলসা করিয়া বলিব না, আভাস দিব মাত্র।

 আমি পাড়াগে'য়ে নেটিভ ডাক্তার, পুলিসের থানার সম্মুখে আমার বাড়ি। যমরাজের সহিত আমার যে পরিমাণ আনুগত্য ছিল দারােগাবাবুদের সহিত তাহা অপেক্ষা কম ছিল না, সুতরাং নর এবং নারায়ণের দ্বারা মানুষের যত বিবিধরকমের পীড়া ঘটিতে পারে তাহা আমার সুগােচর ছিল। যেমন মণির বারা বলয়ের এবং বলয়ের দ্বারা মণির শােভা বৃদ্ধি হয় তেমনি আমার মধ্যস্থতায় দারােগার এবং দারােগার মধ্যস্থতায় আমার উত্তরােত্তর আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটিতেছিল।

 এই-সকল ঘনিষ্ঠ কারণে হাল নিয়মের কৃতবিদ্য দায়ােগা ললিত চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার একট, বিশেষ বধুত্ব ছিল। তাঁহার একটি অরক্ষণীয়া আত্মীয়া কন্যার সহিত বিৰাহের জন্য মাঝে মাঝে অনুরােধ করিয়া আমাকেও প্রায় তিনি অরক্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু, শশী আমার একমাত্র কন্যা, মাতৃহীনা, তাহাকে বিমাতার হাতে সমর্পণ করিতে পারিলাম না। বর্ষে বর্ষে নতন পঞ্জিকার মতে বিবাহের কত শুভলগ্নই ব্যর্থ হইল। আমারই চোখের সম্মুখে কত যােগ্য এবং অযােগ্য পাত্র চতুর্দোলায় চড়িল, আমি কেবল বরযাত্রীর দলে বাহির-বাড়িতে মিষ্টান্ন খাইয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।

 শশীর বয়স বারাে হইয়া প্রায় তেরাে পড়ে। কিছু সুবিধামত টাকার জোগাড় করিতে পারিলেই মেয়েটিকে একটি বিশিষ্ট বড়ােঘরে বিবাহ দিতে পারিব, এমন আশা পাইয়াছি। সেই কর্মটি শেষ করিতে পারিলে অবিলম্বে আর-একটি শুভকর্মের আয়ােজনে মনােনিবেশ করিতে পারি।

 সেই অত্যাবশ্যক টাকাটার কথা ধ্যান করিতেছিলাম, এমন সময় তুলসীপাড়ার হরিনাথ মজুমদার আসিয়া আমার পায়ে ধরিয়া কাঁদিয়া পড়িল। কথাটা এই, তাহার বিধবা কন্যা রাত্রে হঠাৎ মারা গিয়াছে, শতপক্ষ গর্ভপাতের অপবাদ দিয়া দারােগার কাছে বেনামি পত্র লিখিয়াছে। এক্ষণে পুলিস তাহার মৃতদেহ লইয়া টানাটানি করিতে উদ্যত।

 সদ্য কন্যাশােকের উপর এতবড়ো অপমানের আঘাত তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়াছে। আমি ডাকারও বটে, দমােগার বন্ধুও বটে, কোনোমতে উদ্ধার করিতে হইবে।

 লক্ষী যখন ইচ্ছা করেন তখন এমনি করিয়াই কখনও সদয় কখনও খিড়কি-দরজা দিয়া অনাহত আসিয়া উপস্থিত হন। অমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, “ব্যাপারটা বড়ো গুরুতর।” দুটো-একটা কল্পিত উদাহরণ প্রয়ােগ করিলাম, কম্পমান বল হরিনাথ শিশুর মতাে কাঁদিতে লাগিল।

 বিস্তারিত বলা বাহুল্য, কন্যার অত্যষ্টি-সৎকারের সুযোেগ করিতে হরিনাথ ফতুর হইয়া গেল।

 আমার কন্যা শশী করুণ স্বরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, ঐ বুড়ো তােমার, পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাঁদিতেছি।

 আমি তাহাকে ধমক দিয়া বলিলাম, “যা যা, তাের এত খবর দরকার কী।”