পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
দুর্বুদ্ধি
৪৩১

 এইবার সংপাত্রে কন্যাদানের পথ সুপ্রশস্ত হই। বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল। একমাত্র কন্যার বিবাহ, ভােজের আনােজন প্রচুর করিলাম। বাড়িতে গৃহিণী নাই, প্রতিবেশীরা দয়া করিয়া আমাকে সাহায্য করিতে আসিল। সর্বস্বান্ত কত হরিনাথ দিনরাত্রি খাটিতে লাগিল।

 গায়ে-হলুদের দিনে রাত তিনটার সময় হঠাৎ শশীকে ওলাউঠায় ধরিল। রােগ উত্তরােত্তর কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল। অনেক চেষ্টার পর নিস্ফল ঔষধেয় শিশিলা ভূতলে ফেলিয়া ছুটিয়া গিয়া হরিনাথের পা জড়াইয়া ধরিলাম। কহিলাম, “আপ করে, দাদা, এই পাষণ্ডকে মাপ করে। আমার একমাত্র কন্যা, আমার আর কেহ নাই।”

 হরিনাথ শশব্যস্ত হইয়া কহিল, “ডাক্তারবাবু, করেন কী করেন কী। আপনার কাছে আমি চিরঋণী, আমার পায়ে হাত দিবেন না।”

 আমি কহিলাম, “নিরবে আমি তােমার সর্বনাশ করিয়াছি, সেই পাপে আমার কন্যা মরিতেছে।”

 এই বলিয়া সর্বলােকের সমক্ষে আমি চীৎকার করিয়া বলিলাম, “ওগাে, আমি এই বন্ধুর সর্বনাশ করিয়াছি, আমি তাহার দণ্ড লইতেছি; ভগবান আমার শশীকে রক্ষা করুন।”

 বলিয়া হরিনাথের চটিজুতা খুলিয়া লইয়া নিজের মাথায় মারিতে লাগিলাম; বৃদ্ধ ব্যস্তসমস্ত হইয়া আমার হাত হইতে জুতা কাড়িয়া লইল।

 পরদিন দশটা-বেলায় গায়ে-হলুদের হরিদ্রাচিহ্ন লইয়া শশী ইহসংসার হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিল।

 তাহার পরদিনেই দারােগাবাবু কহিলেন, “ওহে, আর কেন, এইবার বিবাহ করিয়া ফেলাে। দেখাশুনার তাে একজন লােক চাই।”

 মানুষের মর্মান্তিক দুঃখশােকের প্রতি এরপ নিষ্ঠর অশ্র শয়তানকেও শােভা পায় না। কিন্তু, নানা ঘটনায় দারােগার কাছে এমন মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়াছিলাম যে, কোনাে কথা বলিবার মুখ ছিল না। দারােগার বন্ধু সেই দিন যেন আমাকে চাবুক মারিয়া অপমান করিল।

 হদয় যতই ব্যথিত থাক, কর্মচঞ্জ চলিতেই থাকে। আগেকার মতােই কাের আহার, পরিধানের বস্তু, এমন-কি চুলায় কাষ্ঠ এবং তার ফিতা পর্যন্ত পরিপ উদ্যমে নিয়মিত সংগ্রহ করিয়া ফিরিতে হয়।

 কাজের অবকাশে যখন একলা ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকি তখন মাঝে মাঝে কানে সেই কণ কণ্ঠের প্রন বাজিতে থাকে, “বাবা, ঐ বুড়ো তােমার পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাঁদিতেছিল।” দরিদ্র হরিনাথের জীর্ণ ঘর নিজের ব্যয়ে ছাইয়া দিলাম, আমার দখবতী গাভীটি তাহাকে দান করিলাম, তাহায় ফধক জোমা মহাজনের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া দিলাম।

 কিছুদিন সদ্যশশাকের দুঃসহ বেদনায় নির্জন সন্ধ্যায় এবং অনি আর কেবলই মনে হইত, আমার কোমলহদয়া মেয়েটি সংসারলীলা শেষ করিয়া তাহার বাপের নিষ্ঠ কমে পরলােকে কোননামতেই শান্তি পাইতেছে না। সে কেন ব্যথিত হইয়া কেবলই আমাকে প্রশ্ন করিয়া ফিরিতেছে, “বাবা, কেন এমন কবি।”

 কিছুদিন এমনি হইয়াছিল, গরিবের চিকিৎসা করিয়া টাকার জন্য তাগিদ করিতে