পারিতাম না। কোনাে ছোটো মেয়ের ব্যামাে হইলে মনে হইত, আমার শশীই যেন পল্লির সমস্ত রগ্ন বালিকার মধ্যে রােগ ভােগ করিতেছে।
তখন পুরাে বর্ষায় পল্লী ভাসিয়া গেছে। ধানের খেত এবং গৃহের অঙ্গনপার্শ্ব দিয়া নৌকায় করিয়া ফিরিতে হয়। ভােররাত্রি হইতে বষ্টি শুরু হইয়াছে, এখনও বিরাম নাই।
জমিদারের কাছারিবাড়ি হইতে আমার ডাক পড়িয়াছে। বাবুদের পান্সির মাঝি সামান্য বিসঘটকু সহ্য করতে না পারিয়া উদ্ধত হইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছে।
ইতিপূর্বে এরূপ দুর্যোগে যখন আমাকে বাহির হইতে হইত তখন একটি লােক ছিল যে আমার পুরাতন ছাতাটি খুলিয়া দেখিত, তাহাতে কোথাও ছিদ্র আছে কি না এবং একটি ব্যগ্র কণ্ঠ বাদলার হাওয়া ও বৃষ্টির ছাট হইতে সযত্নে আত্মরক্ষা করিবার জনা আমাকে বারবার সতর্ক করিয়া দিত। আজ শন্য নীরব গহ হইতে নিজের ছাতা নিজে সধান করিয়া লইয়া বাহির হইবার সময় তাহার সেই স্নেহময় মুখখানি স্মরণ করিয়া একটুখানি বিলম্ব হইতেছিল। তাহার রন্ধে শয়নঘরটার দিকে তাকাইয়া ভাবিতেছিলাম, যে লোেক পরের দুঃখকে কিছুই মনে করে না তাহার সুখের জন্য ভগবান ঘরের মধ্যে এত স্নেহের আয়ােজন কেন রাখিবেন। এই ভাবিতে ভাবিতে সেই শন্য ঘরটার দরজার কাছে আসিয়া বুকের মধ্যে হু হু করিতে লাগিল। বাহিরে বড়ােলােকের ভৃত্যের তর্জনম্বর শনিয়া তাড়াতাড়ি শােক সম্বরণ করিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম॥
নৌকায় উঠিবার সময় দেখি, থানার ঘাটে ভােঙা বাঁধা, একজন চাষা কৌপীন পরিয়া বৃষ্টিতে ভিজিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কী রে।” উত্তরে শনিলাম, গতরাত্রে তাহার কন্যাকে সাপে কাটিয়াছে, থানায় রিপাের্ট করিবার জন্য হতভাগ্য তাহাকে দরগ্রাম হইতে বাহিয়া আনিয়াছে। দেখিলাম, সে তাহার নিজের একমাত্র গাত্রবস্ত্র খুলিয়া মৃতদেহ ঢাকিয়া রাখিয়াছে। জমিদারি কাছারির অসহিষ্ণ, মাঝি নৌকা ছাড়িয়া দিল।
বেলা একটার সময় বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখি, তখনও সেই লােক বুকের কাছে হাত পা গুটাইয়া বসিয়া বসিয়া ভিজিতেছে; দারােগাবাবর দর্শন মেলে নাই। আমি তাহাকে আমার রন্ধন-অন্নের এক অংশ পাঠাইয়া দিলাম। সে তাহা ছুইল না।
তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া কাছারির রােগীর তাগিদে পুনর্বার বাহির হইলাম। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়া দেখি তখনও লােকটা একেবারে অভিভূতের মতাে বসিয়া আছে। কথা জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দিতে পারে না, মুখের দিকে তাকাইয়া থাকে। এখন তাহার কাছে এই নদী, ঐ গ্রাম, ঐ থানা, এই মেঘাচ্ছন্ন আর্থ পকিল পৃথিবীটা স্বপ্নের মতাে। বারবার প্রশ্নের দ্বারা জানিলাম, একবার একজন কনস্টেবল আসিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ট্যাকে কিছু আছে কি না। সে উত্তর করিয়াছিল, সে নিতান্তই গরিব, তাহার কিছু নাই। কনস্টেবল বলিয়া গেছে, “থাক্ বেটা, তবে এখন বসিয়া থাক্।”
এমন দৃশ্য পর্বেও অনেকবার দেখিয়াছি, কখনও কিছুই মনে হয় নাই। আজ কোনােমতেই সহ্য করিতে পারিলাম না। আমার শশীর করুণাগদগদ অব্যক্ত কণ্ঠ সমস্ত বাদলার আকাশ জুড়িয়া বাজিয়া উঠিল। ঐ কন্যাছারা বাক্যহীন চাষার