পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
গল্পগুচ্ছ
৪৩৭

শুভদৃষ্টি

কান্তিচন্দ্রের বয়স অল্প, তথাপি প্রীবিয়ােগের পর দ্বিতীয় স্ত্রীর অনুসন্ধান ক্ষান্ত থাকিয়া পশুপক্ষী-শিকারেই মনােনিবেশ করিয়াছেন। দীর্ঘ কৃশ কঠিন লঘু, শরীর, তীক্ষ দৃষ্টি, অব্যর্থ লক্ষ্য, সাজসজ্জায় পশ্চিমদেশীর মতাে; সঙ্গে সঙ্গে কুস্তিগির হীরা সিং ছক্কনলাল, এবং গাইয়ে বাজিয়ে খাঁসাহেব, মিঞাসাহেব অনেক ফিরিয়া থাকে; অকর্মণ্য অনুচর-পরিচরেরও অভাব নাই।

 দুইচারিজন শিকারী বন্ধুবান্ধব লইয়া অঘ্রানের মাঝামাঝি কান্তিচন্দ্র নৈদিঘির বিলের ধারে শিকার করিতে গিয়াছেন। নদীতে দুইটি বড়াে বেটে তাঁহাদের বাস, আরও গােটা-তিনচার নৌকায় চাকরবাকরের দল গ্রামের ঘাট ঘিরিয়া বসিয়া আছে। গ্রামবধদের জল তােলা, স্নান করা প্রায় বন্ধ। সমস্ত দিন বন্দকের আওয়াজে জলঞ্চল কম্পমান, সন্ধ্যাবেলায় ওস্তাদি গলার তানকর্তবে পল্লির নিদ্ৰাতন্দ্রা তিরােহিত।

 একদিন সকালে কান্তিচন্দ্র বােটে বসিয়া বন্দকের চোঙ সযত্নে ঘহতে পরিষ্কার করিতেছেন, এমন সময় অনতিদরে হাঁসের ডাক শনিয়া চাহিয়া দেখিলেন, একটি বালিকা দই-হাতে দুইটি তরুণ হাঁস বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া ঘাটে আনিয়াছে। নদীটি ছােটো, প্রায় শ্রোতহীন, নানাজাতীয় শৈবালে ভরা। বালিকা হাঁস দুইটিকে জলে ছাড়িয়া দিয়া, একেবারে আয়ত্তের বাহিরে না যায় এইভাবে, অস্তসতর্ক স্নেহে তাহাদের আগলাইবার চেষ্টা করিতেছে। এটকু বুঝা গেল, অন্য দিন সে তাহার হাঁস জলে ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইত, কিন্তু সম্প্রতি শিকারীর ভয়ে নিশ্চিন্তচিত্তে রাখিয়া যাইতে পারিতেছে না।

 মেয়েটির সৌন্দর্য নিরতিশয় নবীন, যেন বিশ্বকর্মা তাহাকে সদ্য নির্মাণ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন। বয়স ঠিক করা শক্ত। শরীরটি বিকশিত কিন্তু মুখটি এমন কাঁচা যে, সংসার কোথাও যেন তাহাকে লেশমাত্র স্পর্শ করে নাই। সে যে যৌবনে পা ফেলিয়াছে, এখনও নিজের কাছে সে খবরটি তাহার পপীছে নাই।

 কান্তিচন্দ্র ক্ষণকালের জন্য বন্দকে সাফ করায় ঢিল দিলেন। তাঁহার চমক লাগিয়া গেল। এমন জায়গায় এমন মুখ দেখিবেন বলিয়া কখনও আশা করেন নাই। অথচ, রাজার অন্তঃপুরের চেয়ে এই জায়গাতেই এই মুখখানি মানাইয়াছিল। সােনার ফুলদানির চেয়ে গাছেই ফলকে সাজে। সেদিন শরতের শিশিরে এবং প্রভাতের রৌদ্রে। নদীতীরের বিকশিত কাশবনটি ঝলমল করিতেছিল, তাহারই মধ্যে সেই সরল নবীন মুখখানি কান্তিচন্দ্রের মুখ চক্ষে আশ্বিনের আসন্ন আগমনীর একটি আনন্দবি আকিয়া দিল। মন্দাকিনীতীরে তরুণ পার্বতী কখনও কখনও এমন হংসশিশু, বকে লইয়া আসিতেন, কালিদাস সে কথা লিখিতে ভুলিয়াছেন।

 এমন সময় হঠাৎ মেয়েটি ভীতত হইয়া কাঁদোকাঁদো মুখে আড়াতাড়ি হল দটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া অব্যক্ত আতরে ঘাট ত্যাগ করিয়া চলি। কাচিন্দ্র কারণসখানে বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, তাহার একটি রসিক পারিণকৌতুক করিয়া বালিকাকে ভয় দেখাইবার জন্য হাঁসের দিকে ফাকা বন্দকে লক্ষ্য করিয়েছে। কাতি পশ্চাৎ হইতে কক কাভিন্ন লইয়া হঠাৎ তাহার গালে সঙ্গে প্রকাণ্ড একটি চপেটাঘাত