পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৪৪০
গল্পগুচ্ছ

করিয়াছিলেন; সেই প্রতিজ্ঞা কি এমনি একটা অদ্ভুত পরিহাসে অদৃষ্ট তুড়ি দিয়া ভাঙিয়া দিল। কত ভালাে ভালাে বিবাহের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়াছেন, কত আত্মীয়বন্ধুবান্ধবদের সানুনয় অনুরােধ অবহেলা করিয়াছেন; উচ্চকুটবিতার আকর্ষণ, অর্থের প্রলােভন, রপখ্যাতির মােহ, সমস্ত কাটাইয়া অবশেষে কোন এক অজ্ঞাত পল্লিগ্রামে বিলের ধারে এক অজ্ঞাত দরিদ্রের ঘরে এতবড়াে বিড়ম্বনা, লােকের কাছে মুখ দেখাইবেন কী করিয়া॥

 শ্বশুরের উপরে প্রথমটা রাগ হইল। 'প্রতারক এক মেয়ে দেখাইয়া আর-এক মেয়ের সহিত আমার বিবাহ দিল। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলেন, নবীন তাে তাঁহাকে বিবাহের পূর্বে কন্যা দেখাইতে চান নাই এমন নয়, তিনি নিজেই দেখিতে অসম্মত হইয়াছিলেন। বুদ্ধির দোষে যে এতবড়ো ঠকাটা ঠকিয়াছেন সে লজ্জার কথাটা কাহারও কাছে প্রকাশ না করাই শ্রেয়ঃ বিবেচনা করিলেন।

 ঔষধ যেন গিলিলেন কিন্তু মুখের তারটা বিগড়াইয়া গেল। বাসরঘরের ঠাট্টা অমােদ কিছুই তাহার কাছে রচিল না। নিজের এবং সর্বসাধারণের প্রতি রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জলিতে লাগিল।

 এমন সময় হঠাৎ তাঁহার পার্শ্ববর্তিনী বধু অব্যক্ত ভীত স্বরে চমকিয়া উঠিল। সহসা তাহার কোলের কাছ দিয়া একটা খরগােসের বাচ্ছা ছুটিয়া গেল। পরক্ষণেই সেদিনকার সেই মেয়েটি শশকশিশুর অনুসরণ-পূর্বক তাহাকে ধরিয়া গালের কাছে রাখিয়া একান্ত স্নেহে আদর করিতে লাগিল। “ঐ রে, পাগলি আসিয়াছে” বলিয়া সকলে তাহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিল। সে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করিয়া ঠিক বরকন্যার সম্মুখে বসিয়া শিশুর মতো কৌতহলে কী হইতেছে দেখিতে লাগিল। বাড়ির কোনাে দাসী তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইবার চেষ্টা করিলে বর ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “আহা, থাক-না, বসুক।”

 মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তােমার নাম কী।”

 সে উত্তর না দিয়া দলিতে লাগিল।

 ঘরসুদ্ধে রমণী হাসিয়া উঠিল।

 কান্তি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার হাঁসদটি কতবড়ো হইল।”

 অসংকোচে মেয়েটি নীরবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। হতবুদ্ধি কান্তি সাহসপুর্বক আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার সেই ঘঘ, আরাম হইয়াছে তাে?” কোনাে ফল পাইলেন না। মেয়েরা এমনভাবে হাসিতে লাগিল যেন বর ভারি ঠকিয়াছেন।

 অবশেষে প্রশ্ন করিয়া খবর পাইলেন, মেয়েটি কালা এবং বােবা, পাড়ার যত পশুপক্ষীর প্রিয়সগিনী। সেদিন সে যে সুধা ডাক শুনিয়া উঠিয়া ঘরে গিয়াছিল সে তাঁহার অনুমানমাত্র, তাহার আর-কোনাে কারণ ছিল।

 কান্তি তখন মনে মনে চমকিয়া উঠিলেন। যাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া পৃথিবীতে তাঁহার কোনাে সুখ ছিল না, শুভদৈবক্রমে তাহার নিকট হইতে পরিত্রাণ পাইয়া নিজেকে ধন্য জ্ঞান করিলেন। মনে করিলেন, যদি এই মেয়েটির বাপের কাছে যাইতাম এবং সে ব্যক্তি আমার প্রার্থনা-অনুসারে কনাটিকে কোনােমতে আমার হাতে সমর্পণ করিয়া নিতি লাভের চেষ্টা করিত!