৪৬২ গল্পগুচ্ছ বাংলার রাস্কিন নাম দিয়েছেন। শনিয়া ভূপতি কিছু সংকুচিতভাবে কাগজখানা হাতে করিয়া লইল। খলিয়া দেখিল, লেখাটির নাম আষাঢ়ের চাঁদ। গত দুই সপ্তাহ ধরিয়া ভূপতি ভারতগবমেন্টের বাজেট-সমালোচনা লইয়া বড়ো বড়ো অঙ্কপাত করিতেছিল, সেই-সকল অঙ্ক বহুপদ কীটের মতো তাহার মস্তিকের নানা বিবরের মধ্যে সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল— এমন সময়ে হঠাৎ বাংলা ভাষায় আষাঢ়ের চাঁদ প্রবন্ধ আগাগোড়া পড়িবার জন্য তাহার মন প্রস্তুত ছিল না। প্রবন্ধটিও নিতান্ত ছোটো নহে। লেখাটা এইরপে শরে হইয়াছে— ‘আজ কেন আষাঢ়ের চাঁদ সারারাত মেঘের মধ্যে এমন করিয়া লুকাইয়া বেড়াইতেছে! যেন বগলোক হইতে সে কী চুরি করিয়া আনিয়াছে, যেন তাহার কলঙ্ক ঢাকিবার স্থান নাই। ফালগন মাসে যখন আকাশের একটি কোণেও মুষ্টিপরিমাণ মেঘ ছিল না তখন তো জগতের চক্ষের সম্মুখে সে নিলজের মতো উন্মুক্ত আকাশে আপনাকে প্রকাশ করিয়াছিল— আর আজ তাহার সেই ঢলঢল হাসিখানি–শিশর সবনের মতো, প্রিয়ার সমতির মতো, সরে্বরী শচীর অলকবিলম্বিত মুক্তার মালার মতো— ভূপতি মাথা চুলকাইয়া কহিল, “বেশ লিখেছে। কিন্তু আমাকে কেন। এ-সব কবিত্ব কি আমি বুঝি।” চার সংকুচিত হইয়া ভূপতির হাত হইতে কাগজখানা কাড়িয়া লইয়া কহিল, “তুমি তবে কী বোঝ।” ভূপতি কহিল, "আমি সংসারের লোক, আমি মানুষ বুঝি " চার কহিল, “মানুষের কথা বঝি সাহিত্যের মধ্যে লেখে না ?” ভূপতি। ভুল লেখে। তা ছাড়া মানুষ যখন সশরীরে বর্তমান তখন বানানো কথার মধ্যে তাকে খুজে বেড়াবার দরকার : বলিয়া চারুলতার চিবকে ধরিয়া কহিল, “এই যেমন আমি তোমাকে বুঝি, কিন্তু সেজন্য কি ‘মেঘনাদবধ কবিকঙ্কণচণ্ডী আগাগোড়া পড়ার দরকার আছে।” ভূপতি কাব্য বোঝে না বলিয়া অহংকার করিত। তব অমলের লেখা ভালো করিয়া না পড়িয়াও তাহার প্রতি মনে মনে ভূপতির একটা শ্রদ্ধা ছিল। ভূপতি ভাবিত, বলিবার কথা কিছুই নাই অথচ এত কথা অনগ’ল বানাইয়া বলা সে তো আমি মাথা কুটিয়া মরিলেও পারিতাম না। অমলের পেটে যে এত ক্ষমতা ছিল তাহা কে জানিত।’ ভূপতি নিজের রসজ্ঞতা অস্বীকার করিত কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তাহার কৃপণতা ছিল না। দরিদ্র লেখক তাহাকে ধরিয়া পড়িলে বই ছাপিবার খরচ ভূপতি দিত, কেবল বিশেষ করিয়া বলিয়া দিত, “আমাকে যেন উৎসগ করা না হয়।” বাংলা ছোটো বড়ো সমস্ত সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্র, খ্যাত অখ্যাত পাঠ্য অপাঠা সমসত বই সে কিনিত । বলিত, “একে পড়ি না, তার পরে যদি না কিনি তবে পাপও করিব প্রায়শ্চিত্তও হইবে না।” পড়িত না, বলিয়াই মন্দ বইয়ের প্রতি তাহার লেশমাত্র বিদ্বেষ ছিল না, সেইজন্য তাহার বাংলা লাইব্রেরি গ্রন্থে পরিপাণ ছিল। অমল ভূপতির ইংরাজি প্রফ-সংশোধনকাযে সাহায্য করিত ; কোনো-একটা কাপির দবোধ্য হসন্তাক্ষর দেখাইয়া লইবার জন্য সে একতাড়া কাগজপত্র লইয়া ঘরে ঢাকিল। ভূপতি হাসিয়া কহিল, "অমল, তুমি আষাঢ়ের চাঁদ আর ভাদ্র স্বাসের পাকা
পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৫১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।