পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৭২ গল্পগুচ্ছ শিখিয়াছিল, বাহ হইতে নিগমন শেখে নাই— নদীর স্রোত সেইরাপ গিরিদরীর পাষাণ-জঠরের মধ্যে থাকিয়া কেবল সমখেই চলিতে শিখিয়াছিল, পশ্চাতে ফিরিতে শেখে নাই। হায় নদীর স্রোত, হায় যৌবন, হায় কাল, হায় সংসার, তোমরা কেবল সম্মুখেই চলিতে পার— যে পথে সমতির বর্ণমণ্ডিত উপলখণ্ড ছড়াইয়া আস সে পথে আর কোনোদিন ফিরিয়া যাও না। মানুষের মনই কেবল পশ্চাতের দিকে চায়, অনন্ত জগৎসংসার সে দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।’ এমন সময় মন্দার বারের কাছে একটি ছায়া পড়িল, সে ছায়া মন্দা দেখিতে পাইল। কিন্তু যেন দেখে নাই এইরুপ ভাণ করিয়া অনিমেষদটিতে অমলের মুখের দিকে চাহিয়া নিবিড় মনোযোগের সহিত পড়া শুনিতে লাগিল। ছায়া তৎক্ষণাৎ সরিয়া গেল । চার অপেক্ষা করিয়া ছিল, অমল আসিলেই তাহার সম্মখে বিশ্ববন্ধ কাগজটিকে যথোচিত লাঞ্ছিত করিবে, এবং প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিয়া তাহাদের লেখা মাসিক পত্রে বাহির করিয়াছে বলিয়া অমলকেও ভৎসনা করিবে । অমলের আসিবার সময় উত্তীণ হইয়া গেল তব তাহার দেখা নাই। চার একটা লেখা ঠিক করিয়া রাখিয়াছে ; অমলকে শনাইবার ইচ্ছা ; তাহাও পড়িয়া আছে । এমন সময়ে কোথা হইতে অমলের কন্ঠস্বর শন যায়! এ যেন মন্দার ঘরে ! শরসিদ্ধের মতো সে উঠিয়া পড়িল। পায়ের শব্দ না করিয়া সে বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অমল যে-লেখা মন্দাকে শনাইতেছে এখনও চার তাহা শোনে নাই। অমল পড়িতেছিল— ‘মানুষের মনই কেবল পশ্চাতের দিকে চায়– অনন্ত জগৎসংসার সে দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।’ চার যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল তেমন নিঃশব্দে আর ফিরিয়া যাইতে পারিল না। আজ পরে পরে দই তিনটা আঘাতে তাহাকে একেবারে ধৈর্য চু্যত করিয়া দিল । মন্দা যে একবৰ্ণও বুঝিতেছে না এবং অমল যে নিতান্ত নিবোধ মঢ়ের মতো তাহাকে পড়িয়া শনাইয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছে, এ কথা তাহার চীৎকার করিয়া বলিয়া আসিতে ইচ্ছা করিল। কিন্তু না বলিয়া সক্ৰোধ পদশব্দে তাহা প্রচার করিয়া আসিল। শয়নগহে প্রবেশ করিয়া চার বার সশব্দে বধ করিল। অমল ক্ষণকালের জন্য পড়ায় ক্ষান্ত দিল। মন্দা হাসিয়া চারর উদ্দেশে ইঙ্গিত করিল। অমল মনে মনে কহিল, বউঠানের এ কী দৌরাত্ম্য। তিনি কি ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন, আমি তাঁহারই ক্রীতদাস। তাঁহাকে ছাড়া আর কাহাকেও পড়া শনাইতে পারিব না। এ যে ভয়ানক জলম। এই ভাবিয়া সে আরও উচ্চৈঃস্বরে মন্দাকে পড়িয়া শনাইতে লাগিল। পড়া হইয়া গেলে চারীর ঘরের সম্মখে দিয়া সে বাহিরে চলিয়া গেল। একবার চাহিয়া দেখিল, ঘরের বার রন্ধ। চার পদশব্দে বঝিল, অমল তাহার ঘরের সম্মখে দিয়া চলিয়া গেল—একবারও থামিল না। রাগে ক্ষোভে তাহার কান্না আসিল না। নিজের নতন-লেখা খাতাখানি সতপোকার করিল। হায়, কী কুক্ষণেই এই-সমস্ত লেখালেখি আরম্ভ হইয়াছিল।