তখন রাত্রি দশটা। বাড়ির আর-সকলে আহারাদি সমাধা করিয়া ঘুমাইতে গিয়াছে। এমন সময় আতর মাখিয়া, উড়ানি উড়াইয়া, হঠাৎ গোপীনাথ আসিয়া উপস্থিত হইল। সুধো অনেকখানি জিভ কাটিয়া সাত হাত ঘোমটা টানিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।
গিরিবালা ভাবিল, তাহার দিন আসিয়াছে। সে মুখ তুলিয়া চাহিল না। সে রাধিকার মতো গুরুমানভরে অটল হইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু দশ্যপট উঠিল না, শিখিপুচ্ছচূড়া পায়ের কাছে লুটাইল না, কেহ রাগিণীতে গাহিয়া উঠিল না “কেন পূর্ণিমা আঁধার কর লুকায়ে বদনশশী”। সংগীতহীন নীরসকণ্ঠে গোপীনাথ বলিল, “একবার চাবিটা দাও দেখি।”
এমন জ্যোৎস্নায়, এমন বসন্তে, এত দিনের বিচ্ছেদের পরে এই কি প্রথম সম্ভাষণ! কাব্যে নাটকে উপন্যাসে যাহা লেখে তাহার আগাগোড়াই মিথ্যা কথা! অভিনয়মঞ্চেই প্রণয়ী গান গাহিয়া পায়ে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে- এবং তাহাই দেখিয়া যে দর্শকের চিত্ত বিগলিত হইয়া যায় সেই লোকটি বসন্তনিশীথে গৃহছাদে আসিয়া আপন অনুপমা যুবতী স্ত্রীকে বলে, ওগো, একবার চাবিটা দাও দেখি’! তাহাতে না আছে রাগিণী, না আছে প্রীতি, তাহাতে কোনো মোহ নাই, মাধুর্য নাই—তাহা অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর।
এমন সময়ে দক্ষিনে বাতাস জগতের সমস্ত অপমানিত কবিত্বের মর্মান্তিক দীর্ঘনিশ্বাসের মতো হুহু করিয়া বহিয়া গেল—টব-ভরা ফুটন্ত বেলফুলের গন্ধ ছাদময় ছড়াইয়া দিয়া গেল, গিরিবালার চূর্ণ অলক চোখে মুখে আসিয়া পড়িল এবং তাহার বাসন্তী রঙের সুগন্ধি আঁচল অধীরভাবে যেখানে-সেখানে উড়িতে লাগিল। গিরিবালা সমস্ত মান বিসর্জন দিয়া উঠিয়া পড়িল।
স্বামীর হাত ধরিয়া বলিল, “চাবি দিব এখন, তুমি ঘরে চলো।” আজ সে কাঁদিবে কাঁদাইবে, তাহার সমস্ত নির্জন কল্পনাকে সার্থক করিবে, তাহার সমস্ত ব্রহ্মাস্ত্র বাহির করিয়া বিজয়ী হইবে, ইহা সে দৃঢ় সংকল্প করিয়াছে।
গোপীনাথ কহিল, “আমি বেশি দেরি করিতে পারিব না—তুমি চাবি দাও।”
গিরিবালা কহিল, “আমি চাবি দিব এবং চাবির মধ্যে যাহা কিছু আছে সমস্ত দিব কিন্তু আজ রাত্রে তুমি কোথাও যাইতে পারিবে না।”
গোপীনাথ বলিল, “সে হইবে না। আমার বিশেষ দরকার আছে।”
গিরিবালা বলিল, “তবে আমি চাবি দিব না।”
গোপী বলিল, “দিবে না বই-কি! কেমন না দাও দেখিব।” বলিয়া সে গিরিবালার আঁচলে দেখিল, চাবি নাই। ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার আয়নার বাক্সর দেরাজ খুলিয়া দেখিল, তাহার মধ্যেও চাবি নাই। তাহার চুল বাঁধিবার বাক্স জোর করিয়া ভাঙিয়া খুলিল; তাহাতে কাজললতা, সিঁদুরের কৌটা, চুলের দড়ি প্রভৃতি বিচিত্র উপকরণ আছে—চাবি নাই। তখন সে বিছানা ঘাঁটিয়া, গদি উঠাইয়া, আলমারি ভাঙিয়া, নাস্তানাবুদ করিয়া তুলিল।
গিরিবালা প্রস্তরমূর্তির মতো শক্ত হইয়া দরজা ধরিয়া ছাদের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ব্যর্থমনোরথ গোপীনাথ রাগে গর্গর্ করিতে করিতে আসিয়া বলিল, “চাবি দাও বলিতেছি, নহিলে ভালো হইবে না।”
গিরিবালা উত্তর দিল না। তখন গোপী তাহাকে চাপিয়া ধরিল এবং তাহার