বলে দিলেন, আজই দুপুরবেলা তিনি গোপনে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবেন।”
আর কেহ হইলে কথাটার অসম্ভবতা বুঝিতে পারিত এবং আর কাহারও সম্বন্ধে হইলে কৈলাসবাবুও এ কথায় হাস্য করিতেন, কিন্তু নিজের সম্বন্ধীয় বলিয়া এ সংবাদ তাঁহার লেশমাত্র অবিশ্বাস্য বোধ হইল না। শুনিয়া যেমন খুশি হইলেন তেমনি অস্থির হইয়া উঠিলেন—কোথায় বসাইতে হইবে, কী করিতে হইবে, কেমন করিয়া অভ্যর্থনা করিবেন—কী উপায়ে নয়নজোড়ের গৌরব রক্ষিত হইবে কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। তাহা ছাড়া তিনি ইংরাজি জানেন না, কথা চালাইবেন কী করিয়া সেও এক সমস্যা।
আমি বলিলাম, “সেজন্য ভাবনা নাই, তাঁহার সঙ্গে একজন করিয়া দোভাষী থাকে; কিন্তু ছোটোলাট-সাহেবের বিশেষ ইচ্ছা, আর কেহ উপস্থিত না থাকে।”
মধ্যাহ্নে পাড়ার অধিকাংশ লোক যখন আপিসে গিয়াছে এবং অবশিষ্ট অংশ দ্বার রুদ্ধ করিয়া নিদ্রামগ্ন, তখন কৈলাসবাবুর বাসার সম্মুখে এক জুড়ি আসিয়া দাঁড়াইল।
তকমা-পরা চাপরাসি তাঁহাকে খবর দিল, “ছোটোলাট-সাহেব আয়া।” ঠাকুরদা প্রাচীনকাল-প্রচলিত শুভ্র জামাজোড়া এবং পাগড়ি পরিয়া প্রস্তুত হইয়া ছিলেন, তাঁহার পুরাতন ভৃত্য গণেশটিকেও তাঁহার নিজের ধুতি চাদর জামা পরাইয়া ঠিকঠাক করিয়া রাখিয়াছিলেন। ছোটোলাটের আগমন-সংবাদ শুনিয়াই হাঁপাইতে-হাঁপাইতে কাঁপিতে-কাঁপিতে ছুটিয়া দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন—এবং সন্নতদেহে বারম্বার সেলাম করিতে করিতে ইংরাজবেশধারী আমার এক প্রিয় বয়স্যকে ঘরে লইয়া গেলেন।
সেখানে চৌকির উপরে তাঁহার একমাত্র বহুমূল্য শালটি পাতিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাই উপর কৃত্রিম ছোটোলাটকে বসাইয়া উর্দুভাষায় এক অতিবিনীত সুদীর্ঘ বক্তৃতা পাঠ করিলেন, এবং নজরের স্বরূপে স্বর্ণরেকাবিতে তাঁহাদের বহুকষ্টরক্ষিত কুলক্রমাগত এক আসরফির মালা ধরিলেন। প্রাচীন ভৃত্য গণেশ গোলাপপাশ এবং আতরদান লইয়া উপস্থিত ছিল।
কৈলাসবাবু বারম্বার আক্ষেপ করিতে লাগিলেন যে, তাঁহাদের নয়নজোড়ের বাড়িতে হুজুর-বাহাদরের পদধুলি পড়িলে তাঁহাদের যথাসাধ্য যথোচিত আতিথ্যের আয়োজন করিতে পারিতেন-কলিকাতায় তিনি প্রবাসী-এখানে তিনি জলহীন মীনের ন্যায় সর্ব বিষয়েই অক্ষম-ইত্যাদি।
আমার বন্ধু দীর্ঘ হ্যাট-সমেত অত্যন্ত গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িতে লাগিলেন। ইংরাজি কায়দা-অনুসারে এরূপ স্থলে মাথায় টুপি না থাকিবার কথা, কিন্তু আমার বন্ধু ধরা পড়িবার ভয়ে যথাসম্ভব আচ্ছন্ন থাকিবার চেষ্টায় টুপি খোলেন নাই। কৈলাসবাবু এবং তাঁহার গর্বান্ধ প্রাচীন ভৃত্যটি ছাড়া আর সকলেই মুহূর্তের মধ্যে বাঙালির এই ছদ্মবেশ ধরিতে পারিত।
দশ মিনিট কাল ঘাড় নাড়িয়া আমার বন্ধু গাত্রোত্থান করিলেন এবং পূর্বশিক্ষা-মত চাপরাসি সোনার রেকাবিসুদ্ধ আসরফির মালা, চৌকি হইতে সেই শাল, এবং ভৃত্যের হাত হইতে গোলাপপাশ এক আতরদান সংগ্রহ করিয়া ছদ্মবেশীর গাড়িতে তুলিয়া দিল—কৈলাশবাবু বুঝিলেন, ইহাই ছোটোলাটের প্রথা। আমি গোপনে এক পাশের ঘরে লুকাইয়া দেখিতেছিলাম এবং রুদ্ধ হাস্যবেগে আমার পঞ্জর