পাতা:গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড).djvu/১৪২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৩৮
গল্পগুচ্ছ

হু হু করিয়া বহিয়া যায়, তরুপল্লব ঝর্‌ঝর্‌ মর্‌মর্‌ করে এবং সমুদ্রের অবিশ্রাম উচ্ছ্বসিত ধ্বনি হৃদয়ের অব্যক্ত বাসনাকে দ্বিগুণ দোদুল্যমান করিয়া তোলে।

 একটা বসন্তে তিনটে বিদেশী যুবক আসিয়া মরা গাঙে এমনি একটা ভরা তুফান তুলিয়া দিল।



 রাজপুত্র দেখিলেন, জোয়ার-ভাঁটার মাঝখানে সমস্ত দেশটা থম্‌থম্‌ করিতেছে- কথা নাই, কেবল মুখ চাওয়াচাওয়ি; কেবল এক এগোনো, দুই পা পিছনো; কেবল আপনার মনের বাসনা স্তুপাকার করিয়া বালির ঘর গড়া এবং বালির ঘর ভাঙা। সকলেই যেন ঘরের কোণে বসিয়া আপনার অগ্নিতে আপনাকে আহুতি দিতেছে, এবং প্রতিদিন কৃশ ও বাক্যহীন হইয়া যাইতেছে; কেবল চোখ-দুটা জ্বলিতেছে, এবং অন্তর্নিহিত বাণীর আন্দোলনে ওষ্ঠাধর বায়ুকম্পিত পল্লবের মতো স্পন্দিত হইতেছে।

 রাজপুত্র সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাঁশি আনো, তূরীভেরী বাজাও, সকলে আনন্দধ্বনি করো, হর্‌তনের বিবি স্বয়ম্বরা হইবেন।”

 তৎক্ষণাৎ দহলা নহলা বাঁশিতে ফুঁঁ দিতে লাগিল, দুরি তিরি তূরীভেরী লইয়া পড়িল। হঠাৎ এই তুমুল আনন্দতরঙ্গে সেই কানাকানি চাওয়াচাওয়ি ভাঙিয়া গেল।

 উৎসবে নরনারী একত্র মিলিত হইয়া কত কথা, কত হাসি, কত পরিহাস। কত রহস্যচ্ছলে মনের কথা বলা, কত ছল করিয়া অবিশ্বাস দেখানো, কত উচ্চহাস্যে তুচ্ছ আলাপ। ঘন অরণ্যে বাতাস উঠিলে যেমন শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায়, লতায় বৃক্ষে, নানা ভঙ্গিতে হেলাদোলা মেলামেলি হইতে থাকে, ইহাদের মধ্যে তেমনি হইতে লাগিল।

 এমনি কলরব আনন্দোৎসবের মধ্যে বাঁশিতে সকাল হইতে বড়ো মধুর স্বরে সাহানা বাজিতে লাগিল। আনন্দের মধ্যে গভীরতা, মিলনের মধ্যে ব্যাকুলতা, বিশ্বদৃশ্যের মধ্যে সৌন্দর্য, হৃদয়ে হৃদয়ে প্রীতির বেদনা সঞ্চার করিল। যাহারা ভালো করিয়া ভালোবাসে নাই তাহারা ভালোবাসিল, যাহারা ভালোবাসিয়াছিল তাহারা আনন্দে উদাস হইয়া গেল।